কোহিনুর হীরার ইতিহাস
কোহিনুর হীরার ইতিহাস
কোহিনুর হীরা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। কোহিনুর হীরা এক সময় ভারতের শান ছিল। কিন্তু ভারতের এই বহুমূল্যবান রত্ন বর্তমানে ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের শোভা বৃদ্ধির কাজ করছে। তবে আপনি এটা শুনে অবাক হবে যে, পৃথিবীতে কহিনুরের চেয়েও অনেক দামী ও বড় হীরা থাকা সত্তেও সেগুলো নিয়ে মানুষের মনে তেমন একটা কৌতুহল নেই যতটা কোহিনুর হীরা নিয়ে রয়েছে। আর এর মূল কারণ হলো এই কোহিনূর একটি অভিশপ্ত হীরা। এই হিরে আজ পর্যন্ত যার কাছে গেছে তার জীবন বরবাদ করে দিয়েছে ।তার জীবনে কালো ছায়া নেমে এসেছে। আর এর থেকে বাদ যায়নি মোগল সম্রাট শাহজাহানও। এমনকি এই হীরের অভিশাপে বড় বড় সম্রাজ্য পর্যন্ত ধ্বংস পর্যন্ত হয়ে গেছে।
কোহিনূর হীরা কি আসলেই অভিশপ্ত ?? আর কেনইবা কোহিনুর হীরা কে অভিশপ্ত হীরা বলে মানা হয় ?? এই অভিশপ্ত কোহিনুর হীরার পুরো ইতিহাস জানাবো আজকের এই এপিসোডে। তাই পুরো আর্টিকেল টি পড়ার অনুরোধ রইলো।
কোহিনুর হীরার ইতিহাস প্রায় 5000 বছরের কাছাকাছি পুরনো। কোহিনুর অর্থ আলোর পাহাড় বা অপূর্ব আলোর ঝলকানি। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের গোলকুণ্ডা খনি থেকে এই বহুমূল্যবান হিরো টি প্রথম পাওয়া গেছে। ,একটি সংস্কৃত লেখা থেকে জানা যায় তখন এই হীরার নাম দেয়া হয়েছিল সামন্তীকা হিরা । বলা হয় এটি নাকি শ্রীকৃষ্ণকে দেওয়া ভগবান সূর্যের একটি উপহার । যা বহুদিন শ্রীকৃষ্ণের কাছে ছিল । এরপর প্রায় চার হাজার বছর এই হীরের কোথাও কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
আবার এটি ১৩০৪ সালে ইতিহাসের জায়গা করে নিয়েছে। সে সময়ে এটি মালওয়ার রাজা মেহেলাক দেবের সম্পত্তি ছিল। এরপর আবার 200 বছর এর কোন উল্লেখ ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে এর উল্লেখ আবার পাওয়া যায় বাবর নামা তে। সেখানে বলা হয়েছে ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধের সময়ে গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রম জিৎ সিং তার সমস্ত সম্পত্তি সুরক্ষার জন্য আগ্রার কেল্লায় রেখেছিলেন। যার মধ্যে তিনি এই বহু মূল্যবান রত্ন কোহিনূর হীরে টিকেও রেখেছিলেন। যুদ্ধে জিতে বাবর এই হীরা টিকে নিয়ে নেন।
সে সময়ে এই হীরের চমক এবং সৌন্দর্য দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন মোগল সম্রাট বাবর। তখন তিনি এটির নাম দিয়েছিলেন বাবর হীরা। এরপর দীর্ঘ প্রায় তিনশ বছর এই হীরা মোগল সাম্রাজ্যের সম্পত্তি ছিল। ১৭৩৮ সালের দিকে ইরানি শাসক নাদির শাহ মোগল সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ করে। এক বছর পর ১৭৩৯ সালে তিনি মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ কে হারিয়ে তাকে বন্দী করে সমস্ত রাজ্যের সম্পত্তি লুট করে। আর এর মধ্যে সেই মহামুল্যবান হীরাটিও ছিল।কোথাও বলা হয় তিনি মুহাম্মদ শাহের সাথে নিজের রাজমুকুট অদল বদল করার সময় ছলনার মাধ্যমে এই হিরা নিজের কব্জায় করে ফেলেছিলেন। এই হিরে নিয়ে তিনি চলে যান ইরানে। তারপর তিনি এর নাম দেন কোহিনুর।
এরপর এই কোহিনুর হিরে হাতবদল হয়ে পৌঁছে যায় নাদির শাহের নাতি শাহরুখ মির্জার হাতে । তার কাছ থেকে এই হিরে পৌঁছে যায় নাদির শাহের সেনাপতি আহমেদ আবদালির কাছে। আহমেদ আবদালি পরবর্তীকালে আফগানিস্তানে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করলে এই কোহিনুর হীরা তার বংশের কাছেই থেকে যায়। কিন্তু যখন তার বংশধর সুলতান শাহ সুজা এই হিরে লাহোরে নিয়ে যান তখন এই খবর পৌঁছে যায় শিক সাম্রাজ্যের রাজা রনজিত সিংয়ের কাছে। এরপর ১৮৩৯ সালে সুলতান শাহ সুজা কে যুদ্ধে হারিয়ে এই হীরা নিজের কব্জায় নিয়ে নেন মহারাজা রঞ্জিত সিং। মহারাজা রঞ্জিত সিং এই হিরেকে তার মুকুটে ব্যবহার করেন। তবে তার মৃত্যুর পর কোহিনুর হীরা চলে আসে তার নাবালক ছেলে দিলীপ সিং এর কাছে।
তবে ততদিনে ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৮৪৯ সালে মহারাজা দিলীপ সিং এর সাথে ব্রিটিশদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় দিলীপ সিং ও তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির সাথে লাহোর সন্ধি হয় এবং সেই সন্ধিতে বলা হয় দিলীপ সিং এর কাছে থাকে কোহিনুর হীরা বৃটেনের রানী ভিক্টোরিয়া কে দেওয়া হবে । এরপর ১৮৫০ সালে লর্ড ডাল হৌসি এই বহুমূল্যবান হীরাটিকে লাহোর থেকে মুম্বাই নিয়ে আসে এবং সেখান থেকে লন্ডনে পাঠানো হয় । এরপর তেসরা জুলাই 1850 সালে মহারানী ভিক্টোরিয়া এই হীরে টিকে নিজের পছন্দ মত ডিজাইনে কাটিং তার মুকুটে ব্যবহার করে। যা এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারেই আছে ।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো এই হীরা কিভাবে অভিশপ্ত হীরা হল । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে কোহিনুর হীরা সামন্তীক হীরা নামে ছিল । মহাভারত মতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি তীরের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছিল এবং তার যদুবংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যদিও এর পেছনে অনেক ইতিহাস রয়েছে ।
কোহিনুর হীরা কে যখন খনি থেকে বের করা হয়েছিল। তখন এটা এতটা প্রসিদ্ধ ছিল ন। কিন্তু 1306 খ্রিস্টাব্দে এটি প্রথম চর্চায় আসে। যখন এটা বলা হয়েছিল যে এই হিরে যার কাছে থাকবে সে হবে পুরো পৃথিবীর রাজা। কিন্তু এটাও তখন বলা হয়েছিল একই সাথে তার জীবনে নেমে আসবে অভিশাপ। কিন্তু তখন এই কথা কেউ বিশ্বাস করিনি।
যখন এই হীরা কাকাতিয় বংশে ছিল তখন সে বংশ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায় । সেই সময় ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক কাকাতিয় রাজা প্রতাপ রুদ্রের কাছ থেকে এই হিরেটিকে নিয়ে নেন। তখন যুদ্ধে কাকাতুয়া সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর পর বেশ কিছু বছর পরে এই হিরে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের হাতে আসে। আর এর সাথে সাথেই হুমায়ুনের খারাপ দিন শুরু হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই শেরশাহ দিল্লিতে আক্রমণ করে দিল্লি জয় করে ফেলেন। হুমায়ুন পরবর্তীতে সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যান। যখন শেরশাহের কাছে কোহিনুর হীরা এসেছিল তারপরে তিনি একটি যুদ্ধে খুবই নির্মম ভাবে মারা যান।
এই হীরা পুরো মোগল বংশেই অভিশাপ ডেকে এনেছিল। ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ , ছেলের সাথে বাবার সংঘাত, সিংহাসনের জন্য লড়াই , এইসব মোঘল বংশের সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছিল। সম্রাট শাহজাহান তার ময়ূর সিংহাসনে এই বহু মূল্যবান হীরা টি ব্যবহার করেছিলেন। আর এরপর থেকেই তার খারাপ সময় শুরু হয়ে যায়। নিজের ছেলের হাতে তিনি বন্দী হন এবং বন্দী অবস্থায় তিনি মারা যান। ধীরে ধীরে মোগল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যায়। এই হীরা যখন নাদির শাহ লুট করেছিল তার কিছুদিন পর তার অনুগামীরা তাকে হত্যা করেছিলেন। এরপর কোহিনুর হীরা পৌঁছে যায় আফগানিস্থানে সুজা শাহের কাছে ।
এরপর সুজা শাহকে হারিয়ে মহারাজা রঞ্জিত সিং কোহিনুর কে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কিন্তু এর ঠিক এক বছরের মধ্যেই মহারাজা রঞ্জিত সিং এর মৃত্যু হয়। তারপর দিলীপ সিং এই হীরের মালিক হলেও ব্রিটিশদের আক্রমণে তিনি তার সম্রাজ্য হারান এবং এই হীরা লন্ডনের রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে চলে যায়।
যতগুলো রাজার কাছে এই কোহিনুর হীরা গেছে , সেই সমস্ত রাজা এবং তাঁদের তাদের সাম্রাজ্যেরই পতন ঘটেছে । তাই প্রতিটি পুরুষের জন্য কোহিনুর হীরা কে অভিশপ্ত বলা হয়েছিল। আসলে এই কোহিনুর হীরাটি কোন অভিশপ্ত হীরা নয় । আসলে এটা একটি লোক কথা মাত্র ।
ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এমন কোনো নথি পাওয়া যায়নি যেখানে এই হিরেটিকে অভিশপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই হীরার প্রত্যেক মালিকদের সাথে হওয়ার ঘটনার উপর ভিত্তি করে হিরো টিকে অভিশপ্ত বলা হয়। রানী ভিক্টোরিয়া এই কোহিনুর হীরা কে নিজের সম্পত্তি বানানোর পর ঘোষণা করেন। ইংল্যান্ডের কোন রাজা এই হিরে ব্যবহার করতে পারবে না। শুধুমাত্র রাজার স্ত্রী বা কোন মহিলা এই হিরে ব্যবহার করতে পারবে। কারণ কোহিনূরের অভিশাপ শুধুমাত্র পুরুষ মালিকদের উপরে কাজ করে। সেইমতো ইংল্যান্ডের যখন কোন পুরুষ শাসক এসেছিলেন । তারা কখনোই এই হীরা টি ব্যবহার করেননি।
এই হীরাটি 5000 বছরে বহুবার হাতবদল হয়েছে। এবং এর মালিকেরা এর আকারের অনেক পরিবর্তন করেছে। এই হীরাটি যখন খনি থেকে তোলা হয়েছিল তখন এর ওজন ছিল আনুমানিক প্রায় 800 ক্যারেট। বা প্রায় 160 গ্রাম। বর্তমানে এটির ওজন 105 ক্যারেট বা 21 গ্রাম ক্যারেট। এই কোহিনুর হীরার 33 পার্শ্ব রয়েছে।
এই কোহিনুর হীরার আসল মূল্য ঠিক কত তা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি। কারণ এটিকে কখনোই বিক্রি করা হয়নি বা নিলামে উঠেনি । প্রতিবারই কোন যুদ্ধ বা ছলনার মাধ্যমে এ কোহিনুর হীরা টিকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়েছেন। তবে বিশেশজ্ঞগন এর ঐতিহাসিক দিক এবং এর আকারের ভিত্তিতে এর দাম প্রায় 4 হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে ধারনা করেছেন ।
স্বাধীনতার পর থেকে ভারত পাকিস্তান আফগানিস্তান এমনকি বাংলাদেশও বহুবার এই ছেলেটার উপর নিজেদের মালিকানা দাবি করেছে। তবে প্রতিবারেই ব্রিটিশ সরকার দিলীপ সিং এর সাথে হওয়া লাহোর সন্ধির উল্লেখ করেছেন। ব্রিটেনের এই একটি কথাতেই এই সমস্ত দাবি খারিজ করে দেয়। তাদের দাবি আইনত ভাবে এই হীরে তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু সেই হিসেবে দেখা যায় ব্রিটিশরা সে সময় ছলনার মাধ্যমে এই হীরা টাকে নিয়েছিল। এখানে আপনাদেরকে জানিয়ে রাখি কোহিনুর হল ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের সম্পত্তি। আর রানী এলিজাবেথ হল ইংল্যান্ডের সংবিধানের উপরে। তাই ইংল্যান্ড সরকার চাইলেও কোন আইন পাস করে বা অন্য কোন উপায়ে এই কোহিনুর হীরা অন্য কাউকে দিতে পারবে ন। যতক্ষণ না রানী নিজে এই বিষয়ে সম্মতি দিচ্ছেন।
এই ছিল অভিশপ্ত কোহিনুর হীরা নিয়ে আমাদের আপনাদের আজকের আয়োজন। কেমন লেগেছে আজকের এই এপিসোডটি তা অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন । আর আপনার যদি এই অভিশপ্ত কোহিনুর হীরা সম্পর্কে কোন কিছু জানার বা মতামত দেওয়ার থাকে তাহলেও কমেন্টসে জানাবেন। আর্টিকেল টি ভালো লাগলে লাইক ও শেয়ার করতে ভুলবেন না । পাশাপাশি আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন আর ফেসবুকে আমাদের ফলো করুন । ধন্যবাদ সবাইকে ।
আল্লাহ হাফেজ ।