সম্রাট শাহজাহানের জীবনী | Biography of Samart Shah Jahan
সম্রাট শাহজাহানের জীবনী | Biography of Samart Shah Jahan
এক বাদশা। যিনি একসময় গোটা ভারতবর্ষকে টানা ৩০ টা বছর শাসন করেছিলেন। যার শাসন কালকে মোগল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলা হয। যা ছিল তখনকার সময়ে পৃথিবীর সবথেকে সমৃদ্ধশালী ও শক্তিশালী সম্রজ্য। যে তার প্রিয়তমার ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে নির্মাণ করেছিল তাজমহল যা আজও 500 বছর ধরে ভারতের মাটিতে শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বলছি হতভাগা সম্রাট শাহজাহানের কথা। কি এমন ঘটেছিল সম্রাট শাহজাহানের সাথে যার কারনে এত বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়েও কেন তাকে শেষ জীবন একজন ফকিরের মত খাটতে হয়েছিল। শেষ জীবনে কেন তাকে নিজের ছেলের হাতে বন্দী হতে হয়েছিল এমনকি সেই বন্দি অবস্থায় তিনি অন্ধকার কুঠুরিতে মৃত্যুবরণ করেছিল। সবই জানাবো আজকের এই এপিসোডে।
১৫৯২ সালের ৫ই জানুয়ারি শনিবার সম্রাট শাহজাহান বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট জাহাঙ্গীর। তার মা জগৎ গোসাই ছিলেন হিন্দু রাজপুত রমনী আর সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৃতীয় স্ত্রী। সম্রাট শাহজাহানের সম্রাট হওয়ার আগ পর্যন্ত তার নাম ছিল শাহাব উদ্দিন মোহাম্মদ খুররম ।তিনি ছোটবেলা থেকেই খুবই সাহসী ও বুদ্ধিমান ছিলেন । তাই তার দাদা সম্রাট আকবর তাকে খুবই ভালোবাসতেন । যার ফলে ছোটবেলা থেকেই খুররম দাদা আকবরের কাছ থেকেই নিবিড় যত্নে বড় হতে থাকেন । বলা হয় খুররম পিতা জাহাঙ্গীর এর চেয়ে দাদা আকবরের সাথেই বেশি সময় কাটিয়েছেন।। সম্রাট আকবর চেয়েছিলেন তাকে ভবিষ্যৎ সম্রাট হিসেবে দেখতে তাই তিনি তাকে সেভাবে ই গড়ে তুলেছিলেন।
১৬০৫ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে সম্রাট আকবর মারা গেলে জাহাঙ্গীর ৪র্থ সম্রাট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । শাহজাহান তখন কিছুটা সঙ্গীহীন হয়ে পড়েন । এরপর তিনি ধীরে ধীরে সমস্ত যুদ্ধ বিদ্যা শিখে বিভিন্ন রণকৌশলে পারদর্শী হয়ে ওঠেন ।
১৬০৭ সালে যুবরাজ খুররমের সাথে আরজুমান্দ বানু বেগমের বিবাহ ঠিক হয়। আর সে সময় খুররমের বয়স ছিল 15 বছর এবং আরজুমান্দ বানু বেগম এর বয়স ছিল 14 বছর। এই আরজুমান্দ বানু বেগমই পরবর্তীতে শাহজাহানের প্রিয়তম স্ত্রী মমতাজ মহল হিসেবে পরিচিত হন ।। যার স্মৃতিতে সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন
এদিকে সম্রাট জাহাঙ্গীর সবসময়ই নারীসঙ্গ ও মদ্যপানে লিপ্ত থাকতেন ।। যার ফলস্বরূপ তার শাসন ব্যবস্থা খুব একটা ভালো চলছিল না । ঘটনা ক্রমে ১৬১১ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর নূরজাহান নামের এক অপরূপ সুন্দরী রমণীকে বিয়ে করেন । বিয়ের পরপরই নুরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে গোটা সাম্রাজ্য সম্রাজ্য চালাতে শুরু করে । নুরজাহান যতটা সুন্দরী ছিলেন ঠিক ততটাই বুদ্ধিমতি ছিলেন । জাহাঙ্গীর তখন শুধুমাত্র কাঠের পুতুলের মত নামেমাত্র সম্রাট ছিলেন ।
১৬১২ সালে খুররম আর আরজুমান্দ বানুর সাথে বিয়ে সম্পন্ন হয়। তখন খুররম তাকে ভালবেসে নাম রাখেন মমতাজ মহল অর্থাৎ প্রাসাদের অলংকার ।
কথিত আছে সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইস্যুতে মোট 20 জন স্ত্রী ছিলেন । তাদের মধ্যে নুরজাহানকে তিনি বেশি ভালোবাসতেন আর বাকিদের সাথে তার তেমন একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না । জাহাঙ্গীর এর পক্ষ থেকে নুরজাহানের কোন সন্তান ছিল না ।। এদিকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের পর কে হবে ভবিষ্যত সম্রাট তা নিয়ে মহলে ভিতরে ভিতরে কানাঘুষা চলছিল ।। নুরজাহান তখন বুদ্ধি করে জাহাঙ্গীরের চতুর্থ ছেলে শাহরিয়ার মির্জার সাথে নিজের আগের ঘরের কন্যা শের আফগানের বিবাহ দেন । এরপর নুরজাহান তার স্বামী জাহাঙ্গীর কে পরবর্তী মোগল সম্রাট শাহরিয়ারকে বানানোর জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন জাতেমাতাল কিন্তু তালে ঠিক
শাহজাদা খুররম ব্যাপারটি বুঝতে পারেন । তিনি দেখেন তার পিতা জাহাঙ্গীর সবসময় নেশায় ডুবে থাকেন । আর এই সুযোগে নুরজাহান তার রূপের জাদু দেখিয়ে স্বার্থ আদায় করতে চলেছে । নেশায় মত্ত থেকে জাহাঙ্গীর যেকোনো সময়ে সিংহাসন এর দায়ভার অন্যের হাতে তুলে দিতে পারে । খুররম তখন সিংহাসন বাঁচাতে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন বলে মনস্থির করেন ।
বাস্তবে ময়দানে যুদ্ধ করার আগে আরেকটা যুদ্ধ আমাদের মনের ভেতরে লড়তে হয়। সেসময় মমতাজ মহল শাহজাহানের মনে অনেক সাহস যুগিয়ে ছিলেন। এছাড়াও মমতাজ মহল শাহজাহানের প্রতিটি বিপদে-আপদে পাশে ছিলেন ।। তাই শাহজাহান তার অনন্য স্ত্রীদের থেকে মমতাজ মহল কে সবথেকে বেশি ভালো বাসতেন ।
১৬২৩ সালে শাজাহান মোহাব্বত খান নামে আরেকজন সেনাপতির সাথে মিলিত হয়ে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিশাল এক সৈন্য বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । দুর্ভাগ্যবশত খুররম সেই যুদ্ধে হেরে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে উত্তরপুরের রাজা করণ সিং এর আশ্রয় নেন । এদিকে নুরজাহান খুররমের এই দেশদ্রোহিতা কে হাতিয়ার করে ক্রমাগত জাহাঙ্গীর কে মানসিকভাবে চাপ দিতে থাকেন তার মেয়ের জামাই শাহরিয়ার মির্জাকে পরবর্তী মোগল সম্রাট নিযুক্ত করতে। সম্রাট জাহাঙ্গীর তখন প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সম্রাট জাহাঙ্গীর শারীরিক অসুস্থতার কারণে 28 শে অক্টোবর 1627 সালে মারা যান।
এদিকে এতদিনে নুরজাহানের ভাই আব্দুল হাসান আসফ খান যিনি সম্রাট শাহজাহানের শশুর তিনি জাহাঙ্গীরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জাহাঙ্গীর এর মৃত্যুর পর আসফ খান তস্র বোন নুরজাহানকে বন্দী করে সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন করেন।
খুররম তখন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আসফ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হন ।।
১৬২৮ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি খুররম নিজেকে মোগল সাম্রাজ্যের। সম্রাট ঘোষণা করেন। এরই সাথে তিনি শাহজাহান উপাধি গ্রহণ করেন। যার অর্থ পৃথিবীর রাজা। শাজাহান সিংহাসনে বসে তার সৎ মা নুরজাহানকে আজীবন বন্দি করে রাখার নির্দেশ দেন। শুরু হয় সম্রাট শাহজাহানের রাজত্ব । শিক্ষা বাণিজ্য শক্তিশালী সৈন্য অর্থনৈতিক অবস্থা সবকিছুর দিক দিয়েই সে সময় মোগল সাম্রাজ্য ছিল শ্রেষ্ঠ।
সে সময়ে ভারত বর্ষ ছিল সারা বিশ্বের মধ্যে সবথেকে ধনী দেশ। এই শাহজাহানের আমলেই সোনার, রুপার ও তামার এই তিন ধরনের মুদ্রা প্রচলন শুরু হয়েছিল । তার আমলে মোগল সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় 10 লক্ষ্য।সে সময় শাহজাহানের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর সামনে কোন রাজা মহারাজা বেশি সময় টিকে থাকতে পারত না । সম্রাট শাজাহান খুবই বিলাসবহুল ও অত্যন্ত শিল্পনুরাগী ছিলেন
তিনি গোটা মুঘল সাম্রাজ্য জুড়ে বিখ্যাত কিছু স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন। যার মধ্যে জামা মসজিদ শাহজাহান মসজিদ লালকেল্লা শালিমার গার্ডেন ওয়াজির খান মসজিদ মতি মসজিদ দেওয়ান-ই-আম মিনি কুতুব মিনার দেওয়ান-ই-খাস ময়ূর সিংহাসন মোহাব্বত খান মস্ক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য যা আজও পর্যটকদের মন কাড়ে ।
তবে বলা হয় মানুষের সারাজীবন একরকম যায় না । ১৬৩১ সালের ১৭ ই জুন সকালে
সম্রাট শাহজাহানের সবথেকে প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহল তার 14 তম সন্তান গৌহর বেগমকে জন্ম দানের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মারা যান । আর এতে শাহজাহান এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন জে 7 দিন পর্যন্ত কোনো কিছু না খেয়ে একটি ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দী অবস্থায় রেখেছিলেন । শেষে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মমতাজ মহলের স্মৃতিতে ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ তাজমহল নির্মাণ করবেন । যেই ভাবা সেই কাজ ।। ১৬৩১ সালে তাজমহল নির্মাণ এর কাজ শুরু হয়ে টানা ২০ বছর পর নির্মানের কাজ শেষ হয় । সম্রাট শাহজাহান এতটাই উদার মনের ছিলেন যে তখন শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য রাজ ভান্ডার খুলে দিয়েছিলেন যাতে শ্রমিকেরা নিজেদের ইচ্ছেমতো মজুরি নিতে পারে ।। আর তখন তাজমহলের পিছনে বর্তমান সময়ের প্রায় 7 হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল যার ফলে তখন রাজকোষ একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছিল প্রায় ।
তাজমহল নির্মিত হওয়ার পর সম্রাট শাহজাহান মাঝেমধ্যে নদীপথে তাজমহলে আসতেন এবং মমতাজের সমাধির পাশে সময় কাটাতেন।
শাহজাহানের ইচ্ছে ছিল তার প্রিয় পুত্র দারাশিকো পরবর্তী মুঘল সম্রাট হবেন। কিন্তু তার আরেক ছেলে আওরঙ্গজেব শাহজাহানের এই সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি । কারণ তিনি আগে থেকেই ভবিষ্যৎ সম্রাট হিসেবে নিজেকে ভেবে রেখেছিলেন।। আওরঙ্গজেব তখন তার পিতা শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দারাশিকো কে হত্যা করে। আর দারাশিকোর কাটা মাথা সম্রাট শাহজাহান কে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। নিজের প্রিয় পুত্রের এই পরিণতি দেখে শাজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন । আওরঙ্গজেব তখন তার পিতাকে আগ্রা ফোর্টের একটি ঘরে বন্দী করে রাখেন।
সেই সময়ে শাহজাহান দূর থেকে একটি জানালা দিয়ে যমুনার তীরে তাজমহলকে দেখতেন আর তার ভালোবাসার মানুষটির কথা ভাবতেন। বন্দী অবস্থায় তার মেয়ে জাহানারা তার সেবা যত্ন করতেন ।অনেক ইতিহাসবিদগণ বলেন তাজমহলের আর আগ্রা ফোর্ট এর মধ্যেএকটি গোপন সুরঙ্গ পথ ছিল।। জাহানারা বেগম মাঝে মধ্যে এই সুরঙ্গ পথে তার বৃদ্ধ পিতা শাহজাহানকে তাজমহলে নিয়ে যেতেন।
বৃদ্ধ শাহজাহানের শারিরিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে । এরপর আসে ইতিহাসের সেই বেদনাময় দিন। ১৬৬৬ সালের ২২ই জানুয়ারি সম্রাট শাহজাহান 74 বছর বয়সে আগ্রা প্রতিবন্ধী অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন ।। সম্রাট শাহজাহানের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মমতাজ মহলের পাশে থাকে কবর দেওয়া হয়েছিল ।
তো বন্ধুরা সম্রাট শাহজাহান একজন বিলাসী শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও শেষ জীবনে
বল ছরি একদম ফকির হয়ে গিয়েছিলেন । তাছাড়া নিজের সন্তানের দ্বারা টানা ২০ টা বছর বন্দী থেকে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় রোগে-শোকে ভোগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন । এই বিষয়টি আপনি কিভাবে নিয়েছেন । আসলে আমি নিজেকে খুব ব্যথিত অনুভব করছি।
যাইহোক আপনার অনুভূতিটুকু কমেন্ট বক্সে জানাবেন । ধন্যবাদ সবাইকে আল্লাহ হাফেজ ।
সবকিছুর আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু নেই শাহজাহান মমতাজ। নেই কোনো সম্রাট। মুঘল সাম্রাজ্যে কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো ।
Right
I love Shahajahan
খুবেই মর্মাহত। মানুষের ক্ষমতা স্থায়ী নয়। তাছাড়া, জীবনের সময়টা একই ভাবে যায়না।