সিমেন্ট ছাড়া তাজমহল কিভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল | তাজমহল নির্মানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

 সিমেন্ট ছাড়া তাজমহল কিভাবে  নির্মাণ করা হয়েছিল 

তাজমহল হল মমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শন। কিন্তু আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন যমুনা নদীর তীরে সম্পূর্ণ বালুমাটির উপর একটি ববিল্ডিং নির্মাণ করা বর্তমান যুগে চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কিছুই নয। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই তাজমহলকে আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে কোন আধুনিক টেকনোলজির সাহায্য ছাড়াই কিভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সময় কিন্তু সিমেন্টের আবিষ্কার হয়নি। তাহলে এত বড় মজবুত স্মৃতিস্তম্ভ কিভাবে তারা সিমেন্ট ছাড়াই নির্মাণ করেছিল। তার থেকে বড় অবাক করার বিষয় হলো কেবল কাঠের উপর এই সুবিশাল অট্টালিকা টি কিভাবে ৫০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

আরো একটি অবাক করার ঘটনা হলো কেন শাজাহান তাজমহল এর পেছনে আরো একটি কালো তাজমহল নির্মাণ করার কথা ভেবেছিল। যা দেখতে এই তাজমহলের চেয়েও অনেক সুন্দর হত। কিন্তু কি এমন ঘটেছিল যার কারনে শাহজাহান কেন কালো তাজমহল নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়। সবই জানাবো আজকের এই এপিসোডে। পুরো পোস্ট টি পড়ার অনুরোধ রইল। 



তাজমহলের মত সুবিশাল উঁচু মনুমেন্ট নির্মাণের জন্য শাহজাহান এমন একটি স্থান নির্বাচন করেছিলেন। যা সে যুগের টেকনোলজি অনুযায়ী নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব'। যমুনা নদীর কিনারা বালু মাটিতে ভরা। তার উপর এত বৃহৎ আকৃতির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা বর্তমান যুগে আধুনিক টেকনোলজির সাহায্য নিলেও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। 


অনেকে ইতিহাসবিদদের মতে সেই সময় তাজমহলের ভিত্তি নির্মানের জন্য যখন ইঞ্জিনিয়াররা খোদাইয়ের কাজ করছিল তখন সেই গর্ত থেকে হঠাৎ বালু বের হতে শুরু করে। আর যমুনা নদীর পানি সেই গর্তে গিয়ে পূর্ণ হতে থাকে। এই কারণে সে সময়ে ইঞ্জিনিয়াররা তাজমহল নির্মানের জন্য অন্য একটি স্থান নির্বাচন করতে বলেন। কিন্তু শাহজাহান ছিলেন একরোখা ব্যক্তি। সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে বলেন, তাজমহল যদি নির্মাণ করতে হয় তবে যমুনা নদীর তীরেই করতে হবে। ইঞ্জিনিয়াররা তখন বাধ্য হয়ে যমুনা নদীর তীরে গর্ত করা শুরু করে দেয়।


যতক্ষণ না সলিট মাটি পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ শ্রমিকেরা গর্ত খোঁড়ার কাজ করতে থাকে। সলিড মাটির খোঁজ পাওয়ার পর তার নিচে আরো গর্ত করা হয় । এরপর লোহা পাথরের কনক্রিট আর কাঠ দিয়ে গর্ত পূরন করা হয়। আর এভাবেই তাজমহলের ভিত্তিকে মজবুত করা হয়। 


এই যমুনা নদীর তীরে আলগা মাটির উপর ভিত্তি এতটা মজবুত বানানো হয়েছিল যে, চাইলে তার উপর তাজমহলের থেকেও উঁচু ইমারত নির্মাণ করা সম্ভব ছিল । আপনি শুনলে অবাক হবেন, সেই সময়ের ইঞ্জিনিয়াররা তাজমহলের ভিত্তি নির্মাণের জন্য আবলুস নামের এক ধরনের বিশেষ কাঠের ব্যবহার করেছিল। আর এই কাঠের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, এই কাঠ যত বেশি পানি পাবে  ততই এই কাঠ মজবুত হবে। আর এভাবেই তাজমহলের ভিত্তি আরো মজবুত করা হয়। সেই সময়ের অ্যাডভান্স টেকনোলজি আজকের যুগের এক্সপার্টদের চিন্তার বাইরে। যা আজ থেকে প্রায় 500 বছর আগে ইঞ্জিনিয়াররা বাস্তব রূপ দিতে সমর্থ হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারদের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজই ছিল বালু মাটির উপর ভিত্তি মজবুত করা। কারণ ভিত্তির উপরেই নির্মাণ করা হবে সুবিশাল তাজমহল। ফাইনালি ইঞ্জিনিয়ারদেরই জয় হয়। তারা কাঠ দিয়েই মজবুত ফাউন্ডেশন তৈরি করে ফেলেছিল। এরপর শুরু হয় তাজমহল নির্মানের কাজ। 

বাহির থেকে তাজমহল দেখলে মনে হয় অনেক নামী দামী পাথর দিয়ে তাজমহল নির্মিত হয়েছে। আসলে তাজমহলকে সাধারণ পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। যখন ইমারতের কাজ সম্পন্ন হয় তখন তার ওপর ভিন্ন ভিন্ন মার্বেল পাথর লাগানো হয়। এই প্রসেস টি ছিল ঠিক যেভাবে বাড়িতে ফ্লোরের  ওপর টাইলস লাগানো হয়। কিন্তু তখনকার সময় মার্বেল পাথর লাগানোর পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই সময়ের রঙিন রঙিন মার্বেল পাথর কাটার জন্য কেবলমাত্র একটি সরু তার ব্যবহার করা হয়েছিল। অনেক সময় ধরে ঘষার পর একজন শ্রমিক কেবলমাত্র একটি পাথর কাটতে পারত। 


এখনও যদি তাজমহলের কোন অংশ মেরামতের প্রয়োজন হয় শ্রমিকরা সেই ৫০০ বছর আগের পদ্ধতিতেই তাজমহল মেরামত করে থাকে। তবও আধুনিক কোন যন্ত্রপাতি তাজমহলের মেরামতের কাজে ব্যবহার করা হয় না।


মার্বেল লাগানোর কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর তাজমহলকে বহু মূল্যবান পাথর দিয়ে সাজানো হয়। তাজমহলের দেয়ালে লাগানো হয় বহু মূল্যবান বিভিন্ন রঙের পাথর। রঙিন এই বহু মুল্যবান পাথরগুলোকে সেই সময়ে শাহজাহান চিন আফগানিস্তান শ্রীলঙ্কা পাঞ্জাব আর আরব দেশ থেকে নিয়ে আসেন। পাথরগুলি আনার জন্য হাতি  ব্যবহার করা হয়েছিল।


তাজমহল সম্পর্কিত সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো তাজমহলের নির্মাণ কাজে  কোন সিমেন্ট এর ব্যবহার করা হয়নি। বর্তমানে যত ইমারত দেখা যায় তার সবগুলোই সিমেন্টের দ্বারা নির্মাণ করা হয়। 

কিন্তু তাজমহল সিমেন্ট ছাড়াই আল্ট্রা স্ট্রং। এমনকি ভূমিকম্পেও তাজমহলের এখন পর্যন্ত কোন ক্ষতি হয়নি। তাজমহলের নির্মান কাজ  শুরু হয় ১৬৩১ সালে যখন সিমেন্টের আবিষ্কার হয়নি। তাহলে কিভাবে সিমেন্ট ছাড়াই এতগুলো বছর তাজমহল ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। 


তাজমহল নির্মানের জন্য সে সময়ে ইঞ্জিনিয়াররা এক ধরনের বিশেষ পেস্টের  ব্যবহার করেছিল। যার মধ্যে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত  উপাদান থাকতো। যেমন গুড়, বাতাসা, বেলের শরবত, পাট, নুড়িপাথর ইত্যাদি। এছাড়াও আরো আজব আজব পদার্থ দিয়ে পেস্ট তৈরি করা হতো। আর এই পেস্ট দিয়ে তাজমহলের পাথর গুলিকে জোড়া লাগানো হয়েছিল। এ পেস্ট সিমেন্টের মতোই মজবুত হতো। 


এখানে আরো একটি অবাক করার বিষয় হলো সেই যুগের ইঞ্জিনিয়াররা ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথা চিন্তা করে মেইন বিল্ডিং এর চারটি মিনার সোজা না বানিয়ে বাহির দিকে বাঁকা রেখেছিল। যাতে করে ভূমিকম্পে কখনো যদি মিনারগুলো ভেঙে পড়ে তাহলে মেইন বিল্ডিং এর উপর যেন না পরে কোন ক্ষতি করে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সে সময়ের ইঞ্জিনিয়াররা কতটা এডভান্স ছিল। 


তাজমহাল শুধু মাত্র ভালবাসার প্রতীকই নয়। বরং মোগল আমলের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং আর্কিটেকচারদের অবিশ্বাস্য নিদর্শন ছিল। যদি তাজমহলকে একটু ভালো করে অবজার্ভ করেন তাহলে দেখতে পাবেন মেন বিল্ডিং এর চারটি মিনার সোজা বানানো হয়নি। এগুলো এখনো বাহিরের দিকে ঝুকে রয়েছে। 


তাজমহলের নির্মাণ কার্যক্রম সম্পন্ন হলে শাজাহান তাজমহলের পিছনে অর্থাৎ যমুনা নদীর ওপারে আরো একটি তাজমহল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। যেটি ছিল ব্ল্যাক তাজমহল। শাহজাহান মমতাজের  ছায়ার মধ্যে নিজেকে বন্দী রাখতে চেয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন ওই কালো তাজমহলেই তাকে দাফন করা হয়। 


ইতিহাসবিদদের মতে শাহজাহান তাজমহল নির্মাণের পেছনে সাম্রাজ্যের সমস্ত অর্থ ব্যয় করে ফেলেছিল। তখন রাজকোষে ঘাটতি দেখা দিলে তার পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে টাকা ব্যয় করা থেকে আটকাতে কারাগারে বন্দী করে রাখেন।  


আপনি শুনলে অবাক হবেন সেসময় শাহাজাহান তাজমহলের প্রায় 4 কোটি টাকা খরচ করে করেছিল যা বর্তমান সময় হিসেবে ১০ মিলিয়ন টাকার উপরে। এমত অবস্থায় যদি কালো তাজমহল নির্মাণ করা হতো তাহলে রাজকোষ একদম শূণ্য হয়ে যেত। প্রজারা বিদ্রোহ করত। আর এই কারনেই আওরঙ্গজেব ব্ল্যাক তাজমহল নির্মাণে বাধা সৃষ্টি করেছিল।


বর্তমানে কিছু আর্কিওলজিস্ট যমুনা নদীর ওপারে কাল তাজমহল নির্মানের ফাউন্ডেশনের সন্ধান করে। কিন্তু তারা কোন ক্লু খুঁজে পায়নি। যার কারণে অনেকেই কালো তাজমহলের কাহিনী কে পৌরাণিক ইতিহাস বলে মনে করেন। ঠিক শ্রমিকদের হাত কাটার গল্পের মত। তাজমহল নির্মানের পর সম্রাট শাহজাহান নাকি সমস্ত শ্রমিকদের হাত কেটে দিয়েছিল যাতে তারা তাজমহলের মত অপরুপ অবিশ্বাস্য দ্বিতীয় কোন নিদর্শন বানাতে না পারেন। এই পৌরানিক গল্প পুরোটাই মিথ্যা। আসল কাহিনী হলো 

তাজমহল নির্মানের পর শাজাহান সব কারিগরদের অন্য একটি প্রজেক্টে নিয়োগ করেছিল যাতে তার খেয়ে পরে বেচে থাকতে পারে। তাছাড়া শ্রমিকদের প্রতি শাহজাহানের অত্যাচার বা হাত কাটার ঘটনা ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায়নি। 


আপনার কি মনে সম্রাট শাহজাহান কি আসলেই শ্রমিকদের হাত কেটে দিয়েছিল। আর ভালবাসার অনন্য নিদর্শন তাজমহল যে সিমেন্ট ছাড়া নির্মান করা হয়েছিল এই ইনফরমেশন টি জানার পর আপনার কি মনে হয় ।। এ আমার তো বিশ্বাস করতেই কেমন যেন লাগছে। আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টে জানাবেন। 

সবাইকে এতক্ষণ সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।আল্লাহ হাফেজ।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url