মঙ্গল পান্ডে কে ছিলেন | মঙ্গল পান্ডের জীবনী

মঙ্গল পান্ডে কে ছিলেন | মঙ্গল পান্ডের জীবনী 

১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চ । কলকাতার ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম প্রধান ঘাঁটি। এখান থেকেই বিদ্রোহের ধ্বজা আকাশে উড়েছিল। মঙ্গল পান্ডে নামের একজন সামান্য ভারতীয় সিপাই। তার হাতের বন্দুক থেকে নিক্ষেপ করেছিলেন মহাবিদ্রোহের প্রথম গুলিটি। উপনিবেশবাদী স্বৈরাচারী বৃটিশদের বৈষম্য অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন উন্নত পেশীবহুল দীর্ঘ চেহারার এই মঙ্গল পান্ডে যা পরবর্তীতে সিপাহী বিদ্রোহে রূপ  নিয়েছিল। আর এ বিদ্রোহ পরবর্তীতে ভারতকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করেছিল । ব্রিটিশ কোর্ট মার্শালে তাকে বিশ্বাসঘাতক ও বিদ্রোহী প্রমাণিত করে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছিল । তিনিই ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম জীবন দেওয়া বীর সৈনিক ।


মঙ্গল পান্ডে কে ছিলেন 


এক কথায় বলতে গেলে মঙ্গল পান্ডে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের ৩৪ নং নেটিভ ইনফিনিটির একজন বিচক্ষণ ও সাহসী সিপাহী ছিলেন ।


মঙ্গল পান্ডে ১৮২৭ সালের 19 জুলাই উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার নাগোয়া গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতা দিবাকর পান্ডে ছিলেন একজন কৃষক। মঙ্গলের একটি বোন ছিল। ১৮৩০ সালে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের তার অকাল মৃত্যু ঘটে। তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছিল নিজের পরিবারেই । অর্থনৈতিক অভাবের কারণে কোনরকমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাস করেছিলেন তিনি । অভাবের সংসারে তার  আর পড়াশোনা করা হল না। এরপর দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত পান্ডে 22 বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল আর্মিতে সিপাহী পদে যোগ দিয়েছিলেন । সেনা ছাউনির সবাই তাকে ভালোবাসতেন শ্রদ্ধা করতেন, তার উপর ভরসা করতেন । কারন পান্ডেজি এমন একজন লোক ছিলেন যিনি ডিউটি বাদে বাকিটা সময় পূজা-অর্চনায় কাটাতেন । সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন।

ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যদের বৈষম্য


এখানে চাকরি করতে এসে তিনি অনেক রকম বৈষম্য আর অন্যায় দেখতে পান । ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা প্রতি মুহূর্তে ভারতীয়দের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল। ব্রিটিশদের ক্লাবের বাহিরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকতো কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ। তখন একটি নিয়ম ছিল, কোন ব্রিটিশ অফিসার হেঁটে গেলে তাদেরকে ভারতীয় সিপাহীদের হাতের রাইফেল উচু করে সম্মান জানাতে হত । কিন্তু ভারতীয় কোন অফিসার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে ব্রিটিশ সৈন্যরা কোন ধরনের সম্মান প্রদর্শন করত না। যুদ্ধে কোন ভারতীয় সিপাহীরা মারা গেলে সাদা চামড়ার অফিসাররা তাদের পরিবারের কোনো খোঁজখবর নিত না । কিন্তু ব্রিটিশদের কোন সৈন্য বা অফিসার মারা গেলে অর্থনৈতিক  সহযোগিতাসহ কর্মক্ষেত্র তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে দেওয়া হতো ।


তৎকালীন সময়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল আরো চরম অবস্থানে। তখন ভারতে মোট সৈন্য এবং অফিসারের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ। এই তিন লাখের মধ্যে ব্রিটিশ সৈন্য ও অফিসার ছিল প্রায় ৫০ হাজারের মতো। আর ভারতীয় অফিসার ও সিপাহীদের সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ। মোট সৈন্যদের পিছনে বাজেট ছিল প্রায় ৯৮ লক্ষ পাউন্ড। যার মধ্যে 56 লক্ষ পাউন্ড খরচ হতো 50000 ব্রিটিশ সিপাহী ও অফিসারদের লালসা মেটাতে। আর বাকি 42 লক্ষ পাউন্ড খরচ হতো প্রায় আড়াই লাখ ভারতীয় সেনা সদস্যদের পেছনে। তখনকার সময়ে এদের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ছিল মাত্র 7 রুপি। 

মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহের মূল কারণ


তৎকালীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের যুবকেরা একসাথে চাকরি করতো এবং হিন্দু মুসলিমের মধ্যে ভাল সম্প্রীতি ছিল। হিন্দু ও মুসলিমের এই সম্প্রীতি ব্রিটিশদের ভয়ের অন্যতম কারণ ছিল। তারা এই সম্প্রীতি নষ্টের জন্য সব সময় লেগে থাকত। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ভারতীয় সৈন্যদের সহ্য করতে হচ্ছিল অবর্ণনীয় অপমান। কিন্তু এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন এমন মানুষ কোথায়। এই অবস্থায় এগিয়ে এলেন ছাব্বিশের যুবক মঙ্গল পান্ডে। 


তখনকার দিনে 53 এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ লোড করতে  সামনের অংশটা দাত দিয়ে ছিড়ে বন্দুকে ভরতে হত। পান্ডেজিরা জানতে পারেন, হিন্দু ও মুসলিমদের  বিভেদ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এই কার্তুজগুলো গরুর ও শুয়োরের চর্বি দিয়ে বানানো হতো। আর এই গরু ও শুয়োরের চর্বি ব্যবহারে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মেই  নিষেধাজ্ঞা আছে । যার ফলে ভারতীয় সৈন্যরা এই বন্দুক  প্রত্যাহার করার দাবি জানালে ব্রিটিশ সরকার তা প্রত্যাহার করার  প্রতিশ্রুতি দিলেও তা করতে বিলম্বিত করে । এতে সিপাহীদের মনে জন্ম দেয় তীব্র বিদ্রোহের । দীর্ঘদিনের অত্যাচার, নিপীড়নের ফলে ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে অধিকাংশ ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে মনে। 


একদিন গভীর রাতে কয়েকজন মিলে পান্ডেজির সাথে দেখা করতে আসলেন । পান্ডেজি তাদের দেখেই বুঝতে পারলেন তারা কেন এসেছেন । তিনি তাদেরকে আশ্বাস দিয়ে বললেন । বিদ্রোহের সঠিক সময় এবং মুহূর্ত যেকোনো সময় এসে যাবে। তোমরা সকলে তৈরি থেকো তারা আশ্বাস পেয়ে সবাই ব্যারাকে ফিরে গেলেন  আর অপেক্ষায় রইলেন এবার নিশ্চয়ই কিছু ঘটতে চলেছে । 

মঙ্গল পান্ডের কেন ফাঁসি হয়েছিল


১৮৫৭ সালের 29 শে মার্চ বসন্তকালের মনোরম সকাল। ব্যারাকে ব্যারাকে তৈরি হচ্ছে সিপাহীরা। হঠাৎ সামনের প্যারেডের মাঠে ছুটে এলেন ক্ষিপ্ত প্রায় উদ্ধত একজন সৈনিক। তার হাতে একটি বন্দুক। দীপ্ত ভঙ্গিতে তিনি বন্দুক উচু করে চিৎকার করে উঠলেন। ভাইসব আর চুপ করে বসে থেকো না ভগবানের দোহাই তোমরা বেরিয়ে এসো। গুলি করে মেরে ফেলো ফিরিঙ্গি শয়তানদের। এস মারো মারো। যিনি এই আদেশ করেছিলেন  তিনি আর কেউ নন স্বয়ং মঙ্গল পান্ডে। এই দৃশ্য দেখে সার্জেন্ট মেজর হিউসন সামনের ব্যারাকের দেশীয় সৈন্যদের তাকে গ্রেফতারকরার আদেশ দিলেন। একজন সিপাহী ও তার আদেশ পালন করতে এগিয়ে এলো না। তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন । হিউসন বুঝতে পারলেন । কোন উপায় না দেখে তিনি নিজেই ঘোড়া ছুটিয়ে পান্ডেজির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। তার আগেই পান্ডেজির হাতের বন্দুকটা গর্জে উঠলো। হিউসনের বুকে এসে লাগল সেই গুলিটি। সেখানেই ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন মেজর স্যারজন হিউসন। এরপরে এগিয়ে এলেন লেফটেন্যান্ট বার্গে । পানডেজি তাকেও হাতের তলোয়ারটি দিয়ে মেরে ফেললেন।।


এরপর ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে এলেন কর্নেল হুইলার। মঙ্গল পান্ডে কে দেখে তিনি গর্জে উঠলেন। সিপাহীদের মধ্যে একজন শান্ত গলায় বলে উঠলো পান্ডেজির গায়ে আমরা কেউ হাত দেবনা। অভিজ্ঞ কর্নেল হুইলার বুঝতে পারলেন। তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন ফিরলেন ইউরোপীয় সেনা সদস্যদের নিয়ে । তাদেরকে আদেশ দিলেন মঙ্গল পান্ডে কে গ্রেফতার করতে 


ইউরোপীয় সেনারা ঘিরে ফেলল মঙ্গল পান্ডে কে। পান্ডে জি বুঝলেন তিনি একা এই গোরা সৈন্য দের সাথে লড়তে পারবেন না। ততক্ষণে তিনি তার বন্ধুকে গুলি লোড করে নিয়েছেন । নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে বন্দুকটা নিজের বুকে রেখে গুলি চালিয়ে দিলেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য গুলিটা তার হৃদপিন্ডে না লাগে অন্যদিকে লাগলো। রক্তাক্ত পান্ডে পড়ে গেলেন কিন্তু মারা গেলেন না। রক্তাক্ত আহত অসুস্থ পান্ডেজি কে ইউরোপীয় সৈন্যরা আটক করে নিয়ে গেলেন ।


৬ এপ্রিল ১৮৫৭। সামরিক আদালতে মঙ্গল পান্ডের বিচারসভা বসেছিল । সেদিনও তিনি কোন প্রকার অনুশোচনা না করে, কোন ভয় না পেয়ে সব স্বীকার করে নিয়েছিলেন । সামরিক আদালতের বিচারে মঙ্গল পান্ডে দোষী সাব্যস্ত হলেন। তার ফাঁসির হুকুম হলো। 

মঙ্গল পান্ডের ফাঁসি


৮ ই এপ্রিল ১৮৫৭ সাল। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ব্রিগেড প্যারেডে ফাঁসি দেওয়া হলো স্বাধীনতার এই সূর্য সন্তান মঙ্গল পান্ডে কে । তার রুগ্ন অসুস্থ শরীরটা শরীরটা অনেকক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল খোলা আকাশের নিচে। যাতে এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে অন্য সিপাহীরা বিদ্রোহ হওয়ার সাহস না করে। 

মঙ্গল পান্ডের ফাঁসির পর কি হয়েছিল


মঙ্গল পান্ডে যে বিদ্রোহের সূচনা করেছিলে। তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভারতের বিভিন্ন রজ্যে। বিদ্রোহীরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অস্ত্রাগার লুট করে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ নাগরিকদের হত্যা করে। এই ঘটনার একমাস পরেই শুরু হয় ভারতের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ । আর এই যুদ্ধের হাত ধরে পরবর্তীতে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছিল   এই যুদ্ধের প্রথম জীবন দেওয়া বীর সৈনিক ছিলেন মঙ্গল পান্ডে। 


মঙ্গল পান্ডের বীরত্বকে স্মরণ করে রাখার লক্ষ্যে স্বাধীন ভারতের সরকার ১৯৮৪ সালের ৫ ই অক্টোবর  তার নামে একটি ডাকটিকিট চালু করে । মঙ্গল পান্ডের জীবনীর সাথে মিল রেখে ২০০৫ সালে ভারতে মঙ্গল পাণ্ডে: দ্য রাইজিং নামে একটি মুভি  নির্মাণ হয়েছিল ।। যত অভিনয় করেছিলেন আমির খান ।।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url