একুশে ফেব্রুয়ারির অজানা ইতিহাস

একুশে ফেব্রুয়ারির অজানা ইতিহাস 

 একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষায় কথা বলা সকলের অধিকার | কিন্তু এই অধিকার বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আদায় করতে হয়েছে | এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল । ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এই দিনটি বাংলাদেশে শহীদ দিবস নামে পালিত হতো । কিন্তু ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এটিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত দিন আর বাঙালি জাতীয় জীবনে একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। যেদিন মাতৃভাষার জন্য ৫জন শিক্ষার্থীর তাজা প্রাণ রাজপথে ঝরে গিয়েছিল ।

কেন হয়েছিল ভাষা আন্দোলন আর উর্দু ভাষাকেই কেন পাকিস্তানের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়েছিল ।




১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ভারত পাকিস্তান আলাদা হয়েছিল । তখন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৯০ লক্ষ। এদের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের আর মাত্র আড়াই লক্ষ মানুষ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। এখানে একটি মজার বিষয় হলো পূর্ব-পাকিস্তান তো দূরের কথা তখন পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষই উর্দু ভাষা জানতো না । তাহলে এখানে একটি প্রশ্ন আসে উর্দুকে কেন তারা রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। 


এখানে আপনাদেরকে জানিয়ে রাখি, সেই ইসলামিক শাসন আমল থেকে শুরু করে মোঘল আমলসহ ইন্দো-আর্য পালি-প্রাকৃতের অপভ্রংশ পর্যায়ে ফার্সি,আরবি আর তুর্কি ভাষার প্রভাবে এই উর্দু ভাষা গড়ে ওঠে । উর্দু যেহেতু আরবি হরফে লেখা সেহেতু উর্দু ভাষার প্রতি মুসলমানদের একটি বিশেষ টান ছিল । কিন্তু হিন্দি বাংলা এগুলো ছিল ভিন্ন হরফে লেখা । সেই অনুযায়ী ইসলামিক দিক থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঊর্দুর প্রতি গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়েছিল। 


উর্দু ভাষাটা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সহজ কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল খুবই জটিল ও বেমানান । তার পরেও উর্দুভাষী থেকে বাংলা ভাষীদের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্তেও পূর্ব বাংলার মানুষদের উপর চাপিয়ে দেয়া হতো এই উর্দু ভাষা। আসলে শুধু ভাষার ক্ষেত্রেই নয় স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলার জনগণকে সব দিক থেকেই বঞ্চিত করে আসছিল পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষেরা। কারণ পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন,  সামরিক বাহিনীসহ সব জায়গাতেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা  ছিল ফলে রাষ্ট্রের যেকোন কাজের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব বাঙ্গালীদের থেকে অনেক বেশি ছিল।


বাংলা উর্দু ভাষার লড়াইটা শুরু হয়েছিল দেশ ভাগ হওয়ার আগে থেকেই। কিন্তু এটা মাথাচাড়া উঠলো যখন পাকিস্তান নতুন রাষ্ট্রে পরিনত হল। ১৯৪৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও অফিস আদালত বিদ্যালয় সহ সবখানেই উর্দুকে ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। সেসময় তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ঐ সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি তোলা হয়। কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের তালিকা থেকে বাদ দেয় এবং সাথে সাথে মুদ্রা ডাকটিকিট ট্রেনের টিকেট এবং পোস্টকার্ড থেকেও বাংলার অক্ষর বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহার করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে । সে সময় পাকিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্য জোরদার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এর ফলে পূর্ব-পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলায় ব্যাপকভাবে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। 


8 ই ডিসেম্বর ১৯৪৭ সাল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি তোলা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে। সেসময় অনেক বুদ্ধিজীবীরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, মাতৃভাষার পরিবর্তে উর্দুকে চাপিয়ে দিলে বাংলাভাষী পরবর্তী প্রজন্ম অশিক্ষিত হয়ে পড়বে। বাংলা ভাষার সত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। স্বাধীনভাবে মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে এটিকে বড় আঘাত বলে মনে করা হয়েছিল তখন। তখন মাতৃভাষার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ডিসেম্বরের শেষের দিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। 


এর পরের বছরে ১৯ মার্চ ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে পঙ্গু করে দিতে পূর্ব বাংলায় আসেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। আর এই সফরই ছিল বাংলাদেশ তার জীবনের প্রথম ও শেষ সফর। 


২১ শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সেই সমাবেশে উপস্থিত অনেকেই সাথে সাথে প্রতিবাদ করে ওঠেন। এখানে অবাক করা ব্যাপার হলো, জিন্নাহ কিন্তু নিজে উর্দু লিখতে বা পড়তে পারতেন না, বরং তিনি জানতেন গুজরাটি ভাষা । তারপরও কেন তিনি উর্দুর প্রতি জোর দিয়েছিলেন। ঐ যে আগেই বলেছিলাম বাঙালীদের উপর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভুত্ব শোষণ করার অভিনব এক কৌশল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল উর্দু ভাষার দাবিক। 


১১ ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮। জিন্নাহ মারা গেলেন। তখন জিন্নহর পদে বসলেন খাজা নাজিমুদ্দন। জিন্নাহর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নানারকম প্রস্তাব-পাল্টা প্রস্তাব চলতে থাকে। দেশভাগের পর থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাঙালিরা জোরালোভাবে রাষ্ট্রভাষা গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে মনোভাব ব্যক্ত করে আসছিল। প্রতিক্রিয়া হিসেবে থেমে থেমে আন্দোলন চলছে। তবে এই আন্দোলন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিংগের  জন্ম হয় যখন ১৯৫২ ২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের এসেম্বলীতে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। 


২৭শে জনুয়ারি ১৯৫২। বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন এক সমাবেশে জিন্দার কথাই পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বললেন কোনো জাতি দুইটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনা । সে সময়ও একই ভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই প্রতিবাদে স্লোগান ওঠেছিল।




৩১শে জানুয়ারি ১৯৫২ সাল। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে

৪০ সদস্যের ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে পাকিস্তান সরকার। ঐদিন রাতে বৈঠক করে সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এবং পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’


২১ শে ফেব্রুয়ারি সকাল 9 টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র জড়ো হয়ে সভা করতে থাকে । পুলিশ তাদের সভার চারিদিকে প্রাচীর তৈরি করে টহল দিচ্ছিল ।। দুপুর ২ টার দিকে ছাত্ররা 144 ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মিছিল করতে থাকে তখন পুলিশ এই নিরস্ত্র মিছিলের উপর গুলি চালায়। এতে রফিক, আবুল বরকত আব্দুল জব্বার আব্দুস সালামসহ কয়েকজন ছাত্র হতাহত হন । এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সমবেত হন। রক্তাক্ত 21 শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষকে হতবাক করে দেয়। এ কেমন স্বাধীন দেশে বসবাস করছে তারা। এর পরের দিন 22 শে ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পুনরায় রাজপথে নেমে আসেন। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গাইবি জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। ভাষা শহীদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য 23 শে ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যেই মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে এক স্মৃতিস্তম্ভ। যা পাকিস্তান সরকার 26 শে ফেব্রুয়ারি গুরিয়ে দেয়। 


একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ ই মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় । বাংলা ভাষার মর্যাদা পেল পূর্ব বাংলার জনগণ।। তা বুঝতে পারে এই দেশে তারা মাত্র শুধুমাত্র নামে স্বাধীন। এই আন্দোলনেই স্বাধীন বাংলাদেশের গঠনের বীজ বপন করে। 


১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে পালিত হয় পালিত হয়। সেই বছরই শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ।ভাষা আন্দোলন নিয়ে স্মরণীয় সেই গান  “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…আমি কি ভুলিতে পারি ” সেই বছর প্রথমে কবিতা হিসেবে  লিফলেটে প্রকাশিত হয় । 


১৯৫৭ সালে, নতুন করে বড় আকারে আর্কিটেক্ট হামিদুর রহমানের ডিজাইন্ অনুযায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয় । নির্মাণের কাজ শেষ হলে ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম । 


ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের 17 ই ডিসেম্বর 30 তম অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যা এর আগে বাংলাদেশের মানুষ  শহীদ হিসেবে পালন করে আসছিল ।


জাতিসংঘ ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর ৬৫তম অধিবেশনে জাতিসংঘ পাস করেছে তারা নিয়মিত ভাবে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করবে ।।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url