মমতাজ মহলের জীবন | তাজমহল নির্মানের ইতিহাস | Tajmahal History in bangla
মমতাজ মহলের জীবন | তাজমহল নির্মানের ইতিহাস | Tajmahal History in bangla
যার এক চাহনিতে কাচের টুকরা হীরার মর্যাদা পেয়েছিল। যাকে প্রথম দেখাতেই অন্দর মহলের রানী করে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘাত এমনকি বিশ্বাদ তিক্ততা কোন কিছুতেই যিনি ক্ষনিকের জন্য হলেও স্বামীর ভালবাসার আড়াল হননি। সে কিনা এক বুক যন্ত্রনা আর অভিমান নিয়ে নিমিষেই হারিয়ে গেল । বলছি মোগল সাম্রাজ্যের সবথেকে ভাগ্যবতী মহীয়সী ও হতভাগ্য নারী মমতাজ মহলের কথা ।
ইতিহাসের পাতায় বহু ভালোবাসার কাহিনী রয়েছে। কিন্তু এসবের মধ্যে সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনী আজও জগদ্বিখ্যাত। তাদের ভালোবাসার প্রতীক তাজমহল আজও 400 বছর ধরে দিল্লির মসনদে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে কতজনই বা জানেন। এই তাজমহল কিন্তু মমতাজের প্রথম কবর নয়। মৃত্যুর পরও তাকে মোট তিনবার কবর দেওয়া হয়েছিল কেনই বা মৃত্যু হয়েছিল মমতাজের। কি এমন ঘটে ছিল মমতাজ মহলের সাথে।
২৭ শে এপ্রিল ১৫৯৩ সালে আগ্রার এক পার্শ্বীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি পরবর্তীকালে মমতাজ মহল নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তার মা ছিলেন দিওয়াঞ্জি বেগম । এবং বাবা ছিলেন আব্দুল হাসান আসফ খান। যিনি শাহজাহানের বাবা মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয় পত্নী নুরজাহানের ভাই ও মোগল দরবারের প্রধান ওয়াকিল ছিলেন। আরজুমান্দ বানু বেগম ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী নারী । জীবনের প্রথম বছরগুলিতে আরজুমান্দ কলা এবং অন্যান্য বিদ্যা শিখেছিলেন।
বলা হয় তার সাথে যুবরাজ খুররম অর্থাৎ সম্রাট শাহজাহানের প্রথম দেখা হয় বাজারে একটি হীরা মুক্তা বিক্রির দোকানে। আরজুমান্দ একটি কাচের টুকরা কে মজার ছলে হিরে বলেছিলেন । আর যুবরাজ খুররম বিশাল মূল্য দিয়ে সেই কাচের টুকরোটিকে কিনে নিয়েছিলেন। প্রথম দেখাতেই খুররম আরজুমান্দকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। সেইদিন ই বিকেলে খুররম বাড়িতে গিয়ে তার বাবার কাছে জানিয়ে দেন যে আসফ খানের মেয়ে আর্যুমান্দ কে তার পছন্দ হয়েছে ও তাকে তিনি বিয়ে করতে চান।
৩০ শে এপ্রিল ১৬১২ সালে খুবই ধুম ধামের মধ্যে দিয়ে খুররম ও আরজুমান্দের বিবাহ সম্পন্ন হয়। তবে এর আগেও রাজনৈতিক কারণে ১৬০৯ সালে কন্দাহারি বেগমের সাথে বিবাহ হয়েছিল শাহজাহানের। এবং মমতাজ বেগমের বিবাহের পরেও 1617 সালে ইঁজুন্নেসার।সাথে আবারো বিবাহ হয়। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন মমতাজ মহল কে। এই মমতাজ মহল উপাধিটি সম্রাট শাহজাহান ই তাকে দিয়েছিলেন । যার অর্থ মহলের সবচেয়ে দামি রত্ন। সম্রাট হওয়ার পরশাহজাহান আগ্রা ফোর্টে মমতাজের জন্য একটি মহল তৈরি করে দেন যার চার দেয়াল ছিল হিরে ও বহুমূল্য রত্ন দিয়ে তৈরি ।
শাহজাহান তাকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে সম্রাট হওয়ার পর শাহী সিলমোহর মমতাজের কাছেই রাখতেন। যা রাজকীয় আদেশ জারী করার জন্য ব্যবহার করা হত। মমতাজ বেগম ছিলেন ইসলাম ধর্মের অনুসারী । মমতাজ মহল একজন দক্ষ কবি এবং দক্ষ ধনুকবিদ ছিলেন। মমতাজ বেগম এত টা সুন্দরী রুপবতী ছিলেন যে, তার অপরুপ সৌন্দর্য বিভিন্ন কবিরা তাদের কবিতায় মাধ্যমে উল্লেখ করে গেছেন। মমতাজ মহল ঘুরে বেড়াতে বেশ পছন্দ করতেন এবং শাহজাহানও তাকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চাইতেন না। হাতির লড়াই দেখতে খুব ভালবাসতেন মমতাজ মহল। তাই তিনি সকল যুদ্ধে শাহজাহানের সঙ্গে যেতেন।
তৎকালীন সময়ে দক্ষিণ ভারতে বুরহানপুরের মুঘল সেনাপতি খান জাহান মোহাম্মদ লোদি আহমদনগরের নিজাম শাহের সাথে মিলিত হয়ে সম্রাট শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছিল। লোদীর বিদ্রোহকে দমনের জন্য শাহজাহানকে বোরহানপুর যেতে হয়েছিল। মমতাজ মহলও তার সাথে যেতে চাইছিল। তাই মমতাজ মহল তখন পূর্ন গর্ভবতী থাকা সত্ত্বেও শাহজাহান তাকে আগ্রা থেকে 787 কিলোমিটারে দূরে বোরহানপুর নিয়ে গিয়েছিল। মমতাজ মহল তখন অতিমাত্রায় দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এরপর পরই মমতাজের প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয় আর ওইদিন 16 ই জুন রাতের দিকে সেই যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায় আর সেই সময়ে সম্রাট শাজাহান বিদ্রোহ দমনের জন্য যুদ্ধের রননীতি তৈরিতে ব্যস্ত ছিল।
তার কাছে মমতাজ বেগমের খারাপ অবস্থার খবর গিয়েছিল কিন্তু সে ব্যস্ততার কারনে দেখতে আসেতে পারেন নি। তার বদলে সম্রাট শাহজাহান ধাত্রী অর্থাৎ দায়ীদের পাঠানোর নির্দেশ দেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত মমতাজ মহল যন্ত্রণায় কাতর ছিল। অনেক লম্বা সময় ধরে কষ্ট সহ্য করে মমতাজ মহল গৌহর বেগম নামে একজন কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। মমতাজ মহলের তখন খুব বেশী পরিমানে রক্রখরন হচ্ছিল। দায়ীমা এবং হাকিম তখন মমতাজের শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তস্রাব যাওয়া কে কোনভাবেই থামাতে পারছিল না।
এরপর শাহজাহান যখন নিজে মমতাজকে দেখতে যেতে চেয়েছিল, সে সময় তার কাছে খবর আসে যে মমতাজ তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন। তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে। এটা শুনে শাজাহান নিজে ঘুমাতে চলে যায়,
কারন সারাদিন তার উপর দিয়েও ধকল কম যায়নি। যম্রাট শাহজাহানের যখন সবেমাত্র ঘুমে চোখ লেগেছে। সেই সময় তার মেয়ে জাহানারা নিজে এসে তাকে মমতাজের কাছে যেতে বলেন। শাহজাহান হারেমে গিয়ে দেখে মমতাজকে তখন অনেক হাকিমেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। আর মমতাজ তখন মৃত্যুর যন্ত্রনায় ছটফট করছিল। এর কিছুক্ষণ পরেই সকাল হওয়ার আগেই মমতাজ মহলের মৃত্যু হয়। মমতাজ মহলের মরদেহ তখন তাপ্তি নদীর তীরে জোয়নাবাদ নামক বাগানে কবর দেয়া হয়।
মতাজ এর মৃত্যুর পর শাহজাহান একদম ভেঙে পড়েন। প্রায় এক বছর তিনি রাজ সভায় আস্রন নি । তিনি মমতাজ মহলের কোনভাবেই বলতে পারছিলেন না । তখন তিনি মমতাজের স্মৃতিতে এক অকল্পনীয় সুন্দর মহল তৈরি করার কথা ঘোষণা করেন। মমতাজের মৃতদেহ সোনায় মোড়া কফিনে করে বুরহানপুর থেকে নিয়ে আসা হয় আগ্রাতে। বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ ও প্রজারা তাদের সম্রাজ্ঞীকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গ্রাম এবং শহর জুড়ে পথের দু’ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়েচজিল এবং বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়েছিল। সেসময় পথের দুধারে দাঁড়ানো দরিদ্রদের মাঝে দু’হাতে সোনার মুদ্রা বিতরণ করা হয়েছিল।
শাজাহান সৈন্যদের নিয়ে যমুনা নদীর তীরে মমতাজের কবরের পাশেই দিন কাটাতেন। মমতাজের স্মৃতিতে এই মহল তৈরি হতে 22 বছর সময় লাগে। খরচ হয় চার চার কোটি টাকা। আর মহলের নাম রাখা হয় তাজমহল।
সেসময় মমতাজ মহলের রেখে যাওয়া ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ মিলিয়ন রুপি। যার অর্ধেক তার প্রিয়তমা কন্যা জাহানারাকে দেয়া হয়েছিল। বাকী সম্পদ অন্য সন্তানদের মধ্যে ভাগ করা দেয়া হয়েছিল। এত সম্পদের অধিকারী হয়েও মমতাজ মহল নিজেকে অর্থ প্রাচুর্যের চাকচিক্যের মাঝে গা ভাসিয়ে দেননি বরং সর্বদা স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থেকেছেন, সবসময় শাহজাহানকে রাজ্য পরিচালনাসহ সকল কাজে সহযোগিতা করেছিলেন। তাইতো শাহজাহানও তার ভালবাসার শ্রেষ্ঠ উপহার তাজমহল তৈরি করতে কোনরকম ছাড় দেননি।
তাজমহল তৈরি হওয়ার পর মমতাজের কফিন তাজমহলের প্রধান গম্বুজ এর নিচে কবর দেওয়া হয়। শাজাহান নদীপথে তাজমহলে মাঝেমধ্যে এসে নির্জনে সময় কাটাতেন। তিনি যখন তার পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী হয়েছিলেন তখনো তিনি আগ্রা ফোর্টের জানালা থেকে এই তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। শাহজাহানের মৃত্যুর পর তাকেও মমতাজ মহলের কবরের পাশেই কবর দেওয়া হয়।
বন্ধুরা , মোগল সাম্রাজ্যের এই হতভাগা মহীয়সী নারী মমতাজ মহলের গর্ভ অবস্থায় দূর দেশে ভ্রমন করার কারণেই কি অকাল মৃত্যু হয়েছিল নাকি তার মৃত্যুতে পেছনে আরো কোন রহস্যজনক কারণ থাকতে পারে আপনার কি মনে হয় । তা অবশ্যই আমাদের কমেন্টস করে জানাবেন । আমাদের আর্টিকেল গুলো ভাল লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না । ধন্যবাদ সবাইকে আল্লাহ হাফেজ ।