টাইটানিক নির্মাণের আশ্চর্যজনক ইতিহাস | History of Titanic construction

 স্বপ্নের জাহাজ টাইটানিক । পৃথিবীতে আজ হাজার হাজার জাহাজডুবির ঘটনা আছে, কিন্তু এই একটি জাহাজের দুর্ঘটনা আমরা এখনও ভুলতে পারিনি। ১২০ বছর আগে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা
মনে করলে আজও গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে । এই জাহাজটি বানানোর পরে অহংকার করে বলা হয়েছিল , এই জাহাজটি এমন ভাবে বানানো হয়েছে যা কোনদিন পানিতে ঢুকবে না। কিন্তু এই জাহাজের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল তা আপনার আমার সবারই জানা।

কিন্তু আপনি কি জানেন কীভাবে এই স্বপ্নের জাহাজ টাইটানিক তৈরি হয়েছিল এবং সেই সময়ে কীভাবে বিশাল জাহাজটিকে সমুদ্রে নামানো হয়েছিল। প্রায় 120 বছর আগে, টাইটানিকের চেয়ে বড় জাহাজ ছিল না। সেসময় প্রযুক্তিগত আজকের মত এত উন্নত ছিল না । যার ফলে টাইটানিক জাহাজ নির্মানের শুরু থেকেই নানা রকম বাধা ইঞ্জিনিয়ারদের সামনে আসতে থাকে । আর যেহেতু জাহাজটি অনেক বড় আকারের ছিল তাই ইঞ্জিনিয়ারদের কাছেও এটা অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।

আজকে আমরা টাইটানিক জাহাজ নির্মাণের আশ্চর্যজনক ইতিহাস সম্পর্কে জানব ।

টাইটানিক জাহাজ নির্মানের ইতিহাস

১৯০৯ সালে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হোয়াইট স্টার লাইন বড় একটি যাত্রীবাহী জাহাজ নির্মাণ করার কথা ভেবেছিল । আর তারা এটাও ভেবে রেখেছিল যে এই জাহাজটি ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা পর্যন্ত নিয়মিত যাতায়াত করবে । সেসময় বিলাসবহুল জাহাজ খুব একটা ছিল না । তাই এই বিশাল বড় জাহাজ সম্পর্কে মানুষের মনে ছিল অনেক কৌতুহল । কিন্তু এই জাহাজটির ডিজাইন কে করবে এই নিয়ে তাদের মধ্যে একটা জল্পনা-কল্পনা চলছিল ।

তখনকার সময়ে Alexander Carlisle স্বপ্নের জাহাজ টাইটানিক এর ডিজাইন করেছিলেন । কিন্তু কিছুদিন পরে এই টাইটানিক জাহাজের ডিজাইনে পূর্ণতা আনেন Thomas Andrews . আর এই আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার Thomas Andrews টাইটানিক যখন ডুবে ছিল তখন সেই জাহাজের উপস্থিত ছিল । তাকে লাইফ বোটে যেতে বলা হয়েছিল কিন্তু তাতে তিনি যেতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন । কারণ তিনি এটা ভেবেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে কিভাবে এত বড় জাহাজটি ডুবতে পারে , যা ডুবে যাওয়া একেবারেই  অসম্ভব ছিল । অবশেষে তিনিও একপ্রকার অভিমান করে টাইটানিকের সাথে ডুবে গিয়েছিলেন ।

টাইটানিকের ডিজাইন সম্পন্ন হওয়ার পর আয়ারল্যান্ডের একটি কোম্পানি Harland & Wolff এই বিশাল বড় জাহাজ টি নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিল । জাহাজ সাধারণত সমুদ্রের কাছাকাছি কোন বন্দরে নির্মাণ করা হয় , যেন নির্মাণের পর তা সহজেই পানিতে নামানো যায়। কিন্তু তখন এত বড় বিশাল জাহাজ নির্মাণের জন্য কোন ডক ছিল না । তাই তখন দুটি ডক একসাথে করে একটি ডক বানানো হয়েছিল । আর সেই জোড়া দেওয়ার নতুন ডক থমসনে টাইটানিক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ।

টাইটানিকের নির্মাণ কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় 31 মার্চ, 1990 সালে। Harland & Wolf এই প্রজেক্ট এর নাম দিয়েছিলেন Project 401। তখনকার সময়ে এত উন্নত মানের যন্ত্রপাতি ছিলনা । এই জাহাজটি নির্মাণের কাজে তখনকার সময়ে 15 হাজার শ্রমিক নিয়োজিত ছিলেন । জাহাজটি নির্মাণ করার জন্য প্রায় ৩০ লক্ষ নাট বল্টুর ব্যবহার করা হয়েছিল । আর এই জাহাজে ব্যবহৃত ইঞ্জিনগুলো ছিল বাষ্প চালিত । প্রায় দুই বছর পরে ১৯১১ সালের মে মাসে যখন টাইটানিকের নির্মাণ শেষ হয়েছিল তখন জাহাজটি ৮৮২ ফুট লম্বা এবং এর উচ্চতা ছিল ১৭৫ ফুট এবং ৯২ ফুট চওড়া ছিল। আর টাইটানিক জাহাজ কত বড় ছিল তা এই মাপজোক থেকে আপনি অনুমান করতে পারবেন ।

যদি টাইটানিক কে লম্বালম্বি খাড়া করে রাখা হয় তাহলে সে সময় মানে ২৯১২ সালে মানুষের দ্বারা নির্মিত সকল স্থাপত্যের থেকেও উচু হত এই টাইটানিক। তবে তখনো এর ভেতরের ডিজাইন বাকি ছিল। তখনো টাইটানিকের উপর যে বড় বড় চিমনি গুলো দেখা যায় সেগুলো লাগানো হয়নি।

তবে এর আগে ইঞ্জিনিয়াররা এটা দেখতে চেয়েছিল যে জাহাজটি পানিতে নামানোর পর কি হবে। সেইমতো ১৯১১ সালের ৩১ মে জাহাজ টি প্রথমবারের মতো পানিতে নামানো হয়েছিল। তবে এত বিশাল বড় জাহাজ কে পানিতে নামানো ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। কারণ জাহাজটির তখন ওজন ছিল প্রায় 24 হাজার টন। বলা হয় সেই সময়ে জাহাজটিকে স্লাইডিং করে পানিতে নামানো হয়েছিল। আর যাতে সহজে এটিকে স্লাইডিং করা যায় এই জন্য প্রায় 22 টন সাবান জাতীয় পিচ্ছিল পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছিল। 

যখন জাহাজটি সফলভাবে পানিতে ভাসতে শুরু করে তখন এটিকে আবারো ডকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং এর ভিতরের ডিজাইনের কাজ শুরু করা হয়। আর তখন থেকেই টাইটানিকের যাত্রা নিয়ে বিভিন্ন প্রকার প্রচার-প্রচারণা বিজ্ঞাপন শুরু হয়। যা প্রথম যাত্রায় সাউথহ্যাম্পটন থেকে নিউইয়র্ক যাবে। আর এত বড় বিশাল জাহাজে প্রথম যাত্রার সাক্ষী হতে বহু মানুষ এই জাহাজে যাত্রা করতে আগ্রহী ছিলেন। ফলে টাইটানিক জাহাজের যাত্রার টিকিট তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়।

টাইটানিক এর ভিতরে মোট তিন ধরনের যাত্রীর শ্রেণী ছিল। প্রথমে ছিল ফার্স্ট ক্লাস শ্রেনী যাতে তখনকার দিনে ধনী মানুষদের জন্য সকল প্রকার বিলাসিতার ব্যবস্থা ছিল। সুইমিংপুল জিম সিনেমা হল ক্যাফে ইত্যাদি । এককথায় বিত্তবান ও ধনী ব্যক্তিদের জন্য এই ক্লাসটি ছিল এক ধরনের ভাসমান স্বর্গ।

জাহাজটি সম্পূর্ণ নির্মাণ হয়ে যাওয়ার পর এর ওজন হয়ে যায় প্রায় ৫২ হাজার টন। তবে এত বিশাল বড় একটি জাহাজ চলার জন্য দরকার ছিল একটি খুবই শক্তিশালী ইঞ্জিন । টাইটানিককে চালানোর জন্য এর ভিতরে 29 টি বোল্ট ছিল এবং কয়লা জ্বালানোর জন্য ১৫৯ টি ফার্নিশ ছিল। আর এই ইঞ্জিন চালানোর জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমাণ কয়লার । টাইটানিকের একদিনের যাত্রার জন্য দরকার ছিল প্রায় ৮২৫ টন কয়লা। আর প্রতিদিন ১৭৬ জন কর্মী জাহাজের ফার্নিচে কয়লা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিল । যা খুবই কষ্টকর কাজ ছিল।

বিজ্ঞানীরা একটা হিসাব করে বলেছেন টাইটানিক একদিন চলতে যে পরিমান কয়লা পুড়ত তাতে লন্ডনে ৫০০ টি পরিবারকে এক বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেত।

জাহাজটি নির্মাণ করা হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩৩০০ জন যাত্রীকে পরিবহন করার জন্য। তবে জাহাজটি যেহেতু অনেক বড় ছিল তাই অনেকেই ভেবেছিলেন যে এই জাহাজটি কোনদিনই ঢুকবে না। আর এই কারণে জাহাজে যে পরিমাণ যাত্রী ছিল তার চেয়ে অনেক কম পরিমাণ লাইফ বোট জাহাজে মজুদ ছিল।

অবশেষে ১০ই এপ্রিল ১৯১২ সালে এই জাহাজটি ইংল্যান্ডের সাউথহ্যাম্পটন থেকে তার গন্তব্য নিউ ইয়র্কের দিকে তার প্রথম যাত্রা শুরু করে। সে সময় টাইটানিকে যাত্রীর সংখ্যা ছিল ২২৪০ জম। আর এরপর যা হয়েছিল তা আমরা সকলেই মোটামুটি জানি।

যাত্রা শুরুর মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই ১৫ই এপ্রিল রাতে একটি বরফ খন্ডের সাথে ধাক্কা লাগে টাইটানিকের। বলা হয় এই ধাক্কার ফলে টাইটানিকের নিচের অংশে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় আর হু হু করে সমুদ্রের ঠান্ডা পানি জাহাজে ঢুকে পড়ে।


বিজ্ঞানীদের ধারণা জাহাজটির নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যে মূল কারণ ছিল টাইটানিকে যে নাটবল্টু ব্যবহার করা হয়েছিল তা উন্নত মানের ছিল না অথবা সেগুলো ঠিক ভাবে ওয়েল্ডিং করা ছিল না। আর এই কারনেই বরফের ধাক্কায় টাইটানিকের নিচের বেশ কিছুটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল।

টাইটানিকের এই দুর্ঘটনার সময় যে পরিমাণ যাত্রী টাইটানিকে উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে মাত্র ৭০০ জন যাত্রী বেঁচে ছিলেন । আর বাকি প্রায় দেড় হাজার যাত্রী আটলান্টিক সাগরের ঠান্ডা পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল । আর এখন পর্যন্ত যেই জাহাজটি সমুদ্রের নিচে প্রায় তিন কিলোমিটার নিচে পড়ে আছে ।

এই ছিল আজকের স্বপ্নের জাহাজ টাইটানিক নির্মাণের আশ্চর্যজনক ইতিহাস । আজকের আর্টিকেলটি আপনাদের কাছে কেমন লেগেছে তা অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। চাইলে এই পোস্ট টি  শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।

Next Post Previous Post
2 Comments
  • নামহীন
    নামহীন ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ এ ১০:৩৮ AM

    04 worng word but good information

  • নামহীন
    নামহীন ২৮ জুন, ২০২৩ এ ৮:৩২ AM

    onek bhul ase article e

Add Comment
comment url