লাইলি মজনুর প্রেম কাহিনী

সেই ছোটবেলা থেকেই লায়লী মজনুর ভালোবাসার কথা শুনে আসছি । বর্তমান এই সময়ে আমরা এখনও অনেকেই কারো কারো ভালোবাসাকে লায়লী মজনুর ভালোবাসার সাথে তুলনা করে থাকি । আসলে প্রেম ভালোবাসা পবিত্র একটি বিষয় । একটি সত্তিকারের প্রেম ভালোবাসার মধ্যে অনেক স্বপ্ন, স্বাদ, আকাঙ্ক্ষা, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা নিহিত থাকে। প্রত্যেকটি মানুষই জীবনে অন্তত একবার হলেও কারো না কারো প্রেমে পড়ে থাকেন। ঠিক একই ভাবে একে অপরের ভালবাসায় জড়িয়ে ছিলেন  লায়লী মজনু। আসলে এই লাইলী-মজনু কারা ছিলেন ? কি তাদের বংশ পরিচয়? তাদের সম্পর্কের শুরুটা কিভাবে হয়েছিল এবং তাদের সম্পর্কের শেষ পরিণতিই বা কি হয়েছিল? তাদের ঘিরে এই পুরো গল্পটা জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।

আমাদের সর্বশেষ আপডেট পেতে  Google News  Follow করুন।

লায়লী-মজনু কে ছিলেন

লায়লী-মজনু হল একটি প্রাচীন আরবি লোককাহিনী যা ৭ম শতাব্দীর নজদী বেদুইন কবি কায়েস ইবন আল-মুলাওয়া এবং তার প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদি (পরে লায়লা আল-আমিরিয়া নামে পরিচিত) এর প্রেমের গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। গল্পটি পরবর্তীতে ফারসি কবি নিজামী গাঞ্জাবীর পাঁচ গল্পের আখ্যানমূলক গ্রন্থ 'খামসা' (পাঁচ) খন্ডের তৃতীয় খণ্ডে পাওয়া যায়। পরে এটি একটি প্রেমের কবিতা হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ইংরেজ কবি লর্ড ব্রায়ান তাকে মধ্যপ্রাচ্যের রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট বলেছেন। কিন্তু রোমিও-জুলিয়েটকে যতটা পড়া হয়েছে বা চিত্রিত করা হয়েছে , লায়লী-মজনুর ক্ষেত্রে ততটা হয়নি।কিন্তু তারপরও গল্পটি মানুষের মনে গেঁথে গেছে।

লায়লী-মজনুর প্রেম কাহিনী

বহু বছর আগে আরবে বনু আমির বেদুইন গোত্রের এক মহান শাসক ছিলেন, যার নাম ছিল সাইয়্যিদ। তিনি তৎকালীন আরবের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ছিলেন, যার সম্পদ এত বেশি ছিল যে আরবে তাকে সবচেয়ে ধনী সুলতান বলা হত। অন্যদিকে, তিনি তাঁর উদারতায় অকৃত্রিম ছিলেন। মানুষের প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। তাই তিনি সব সময় মানুষকে সাহায্য করেতেন। আর এ কারণেই তার কথা আরবের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন প্রান্তে  ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু এত কিছুর পরেও একটা বিষয়ে তার মন খারাপ ছিল । আর তা হল তাদের সন্তান ছিল না। এ কারণে তার পরিবারে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছিল। তিনি ও তার স্ত্রী নিয়মিত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে একটা সন্তান চাইতেন। আল্লাহ তাদের মনের বাসনা কবুল করেন। তাদের আল্লাহ সুন্দর ও ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান দান করেন। এতে বাদশা খুশি হয়ে সকল প্রজা ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রচুর টাকা পয়সা ও খাবার বিতরণ করেন । বাদশার এই সন্তান পাওয়ার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যে। তখন ঐ এলাকার সকলেই এই আনন্দে আনন্দিত হয়েছিল।

শিশুর দেখাশোনার জন্য একজন দক্ষ লোক  রাখা হয়েছিল । যেন শিশুটিকে ঠিকমত। শিশুটির কবলে সবসময় একটি কালো ছাপ দিয়ে রাখা হত যেন শিশুটির উপর কারো নজর না পড়ে। তখন এই শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল কায়েস। আর এই শিশুটি পরবর্তীতে মজনু হয়ে উঠেছিল।

কায়েস আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। কায়েস যতই বড় হচ্ছে ততই তার দৈহিক গঠন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কায়েসের শিক্ষাজীবন শুরু হয় মক্তব বা মাদ্রাসা থেকে। কাজ দেখতে যতটা সুন্দর ছিলেন তেমনি তিনি মেধাবীও ছিলেন।
 
কায়েস যে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতেন সেখানে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও পড়তেন। আর এই মাদ্রাসায় যারা পড়াশোনা করত তারা সবাই ছিল বিত্তবান ও অভিজাত বংশের সন্তান। কায়েস যেহেতু খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন তাই মেধাবী কায়েসের সুনাম এই মাদ্রাসার সকল স্তরে ছড়িয়ে পরে।

কিছুদিন পরে সেই মাদ্রাসায় একটি মেয়ে ভর্তি হল। মেয়েটি ছিল অত্যন্ত সুন্দরী ও বিনয়ী স্বভাবের। মেয়েটিকে দেখেই কায়েসের খুব ভালো লেগে যায়। তার কাছে মনে হল যেন এমন সুন্দরী মেয়ে তিনি আর জীবনে কখনো দেখেনি। আপনারা হয়তো ইতিমধ্যে অনুমান করে ফেলেছেন।

এই মেয়েটির নাম ছিল লায়লী। লায়লী নামের অর্থ রাত্রি বা রাত। তার পুরো নাম ছিল লায়লা আল আমিরিয়া। তার মায়াবতী চোখ, লম্বা চুল, সুঠাম দেহ এবং তার অলস এবং আকর্ষণীয় দৃষ্টি মুহূর্তের মধ্যে যে কারো পুরুষের হৃদয় ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতে পারে। তার কণ্ঠ ছিল কোকিলের সুরের মতো। তোর গোলাপি রঙের ঠোঁট ছিল আরো পাগল করা। এক কথায় বলতে গেলে লায়লার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবকিছুই কায়েসকে আকর্ষিত করতে থাকে।

বলা হয় যে, কায়েস যখন তাকে প্রথম দেখেছিল তখন থেকেই তার প্রেমে পড়েছিল। সে তাকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে ফেলেন। কায়েস লায়লী প্রেমে এতটাই পড়ে যান যে তিনি তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেন। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে কায়েস শুধু লায়লীকে নিয়ে কবিতা লিখতে থাকেন। আর লায়লীকে নিয়ে লেখা সেই কবিতাগুলো কায়েস যেখানে সেখানে বসে মানুষদের শোনাতো। একসময় মানুষজন অনেক বিরক্ত হয়ে যেত কিন্তু তারপরও কায়েস তাদের কবিতা শুনিয়ে যেত।  

এক কথায় বলা চলে লায়লীর জন্য পাগল হয়ে গেছে কায়েস। এ কারণে লোকেরা তাকে কায়েস বলা বন্ধ করে মাজনুন অর্থাৎ দিওয়ানা বলে ডাকতে শুরু করে। আর এর বাংলা উচ্চারণ মজনু । আর সেই থেকেই এই কায়েসের নাম হয়ে যায় মজনু। ধীরে ধীরে মজনুর আচরণ এমন হয়ে যায় যে তাকে দেখলে একজন পাগলের মতোই মনে হয়।

এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর মজনু সরাসরি লায়লীর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লায়লীর বাবা তৎক্ষণাৎ বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ লায়লীর বাবা তার মেয়েকে কোনো পাগলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান না। আসলে মজনু পাগল ছিল না। লায়লীর প্রেমে মত্ত হয়ে অনেকটা পাগলের মতোই আচরণ করতেন। আর লায়লীর বাবা এটাকে পাগল ভেবে লায়লীকে তার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হন নি । বরং মজনুর সাথে একজন পাগলের মতো ব্যবহার করে থাকেন ।

কিন্তু অন্যদিকে লায়লীও মজনুকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু এই ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ার কারণে তিনি মজনুকে এ কথা বলতে পারেননি। 

পরে একদল বেদুইন মজনুর নিঃশর্ত ভালোবাসা দেখে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে এবং তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ বেদুইন যুদ্ধ করে লায়লাকে মজনুর কাছে এনে দেবে বলে উৎসাহ দেয় । তাদের সহায়তায়, লায়লার বংশ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু তারপরেও লায়লার বাবা   লায়লী  কে মজনুর সাথে বিয়ে দিতে সম্মত হননি। লায়লীকে তার বাবা অন্যত্র বিয়ে করতে বাধ্য করেন।

লায়লীর বাবা মজনুর সাথে তার বিয়ে না দিয়ে একজন ধনী বৃদ্ধের সাথে লায়লীর বিয়ে ঠিক করেন। তাই এই বিয়েতে লায়লী কিছুতেই রাজি ছিলেন না। কিন্তু বংশের মান সম্মান ও পরিবারের ভালোর কথা চিন্তা করে একপ্রকার জোর করেই লায়লীর বাবা সেই বৃদ্ধের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় লায়লীকে

এ খবর শুনে মজনু রাগে, ক্ষোভে, হতাশায় ও দুঃখে শহর-গ্রাম ত্যাগ করে জঙ্গলে চলে  গেলেন। সেখানে মজনু বনের বিভিন্ন বন্য প্রাণীর সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। তবে বনে গিয়েও কবিতা লেখা বন্ধ করেননি মজনু। এই জঙ্গলে বয়সেও লায়লীকে নিয়ে মজনু লিখতেন কবিতা।

এদিকে লায়লী তার বিবাহিত স্বামীকে মেনে নেয়নি। মজনুর জন্য প্রায় সবসময় কাঁদে। মাঝে মাঝে লায়লা বুড়োকে পায়ে লাথি দিত। যেহেতু তাকে জোর করে বৃদ্ধের সাথে বিয়ে দিয়েছিল, তাই লায়লী বৃদ্ধকে পছন্দ করতেন না। তবে তিনি ধনী, সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় ভালো গৃহবধু সেজে স্বামীর সংসার করতে থাকে।

অন্যদিকে মজনুরের শোকে তার বাবা-মা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন । তারপরেও মজনু  বাবা-মাকে একবারও দেখতে আসেনি। সে জঙ্গলে বসে শুধু লায়লীকে নিয়েই কবিতা লিখতে থাকেন। সে জঙ্গলে কাউকেই পায়না। তাই সে একাই কবিতা আবৃত্তি করে। বালিতে বা মাটিতে লায়লাকে নিয়ে বিভিন্ন  ধরনের কল্পনা করে কবিতা লিখতেন।

কয়েক বছর পর, মজনুর বাবা-মা দুজনেই মারা যান এবং লায়লী নিজেই এই খবরটি মজনুকে জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার স্বামী খুব চালাক ছিল। সে কারণে সে বনে গিয়ে মজনুর সঙ্গে দেখা করতে পারে নি। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে লায়লী এই কাজের দায়িত্ব দেন এক বৃদ্ধকে। একদিন সেই বুড়ো বনে গিয়ে মজনুকে এই খবর দিল। মজনু কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে । অনেকক্ষণ এভাবে কান্নাকাটি করার পর সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যে সে আর কখনো শহরে আসবে না। বাকি জীবন সে বনেই কাটিয়ে দিবে।

সৌভাগ্যক্রমে, লায়লীর বৃদ্ধ স্বামী কয়েকদিন পর মারা যান। তখন লায়লী মজনুর কাছে যেতে চাইলেন। লায়লী মনে মনে ভাবল সে মজনুর সাথে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে।

কিন্তু বেদুইন প্রথা অনুসারে, একজন মহিলার স্বামী মারা গেলে, তাকে কমপক্ষে দুই বছর বাড়িতে থাকতে হবে এবং বাড়িতে বসে তার মৃত স্বামীর জন্য শোক করতে হবে। অন্যথায় শাস্তির বিধান রয়েছে। এ কারণে লায়লী ঘর থেকে বের হতে পারেননি।

কিন্তু লায়লী এই দুই বছর মজনুকে কিভাবে না দেখে থাকবে ? এই ভেবে ভেবে শোকে শোকে সেই ঘরে বসেই লায়লী মারা যান। মজনু যখন শোনে যে লায়লী মারা গেছে, মজনু কাঁদতে কাঁদতে জঙ্গল ছেড়ে বাহিরে চলে আসেন।

আর এরপর থেকে মজনু লায়লীর কবরের পাশে বসে শুয়ে কাঁদতে থাকে। আর এভাবেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কেঁদে ছিলেন। এক সময় এভাবে কাঁদতে কাঁদতে লায়লীর কবরের উপরে মজনুর মৃত্যু হয়। মজনুর নিথর মৃতদেহ পড়ে থাকে লায়লীর কবরের উপর।

লাইলী মজনুর প্রেমের গল্প নিয়ে বিতর্ক

কিছু সূত্র থেকে জানা যায় যে তাদের বাবা-মা উভয়েই তাদের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তারা ভারতে চলে যান। কেউ কেউ বলেন যে লায়লী মজনু ভারতের রাজস্থানে চলে আসেন এবং রাজস্থানের অনুপগড়ে তাদের একটি মাজার রয়েছে।

অনেকে বলেন, লায়লীর বৃদ্ধ স্বামী মজনুকে হত্যার জন্য জনবল নিয়ে বনে গিয়ে মজনুকে খুঁজে পেয়ে তাকে প্রচণ্ড মারধর করে। আবার অনেকে বলেন, মজনুকে আঘাত করা হলে জাদুকরীভাবে লায়লীর শরীরেও একই পরিমাণ আঘাত লাগত। এভাবে লায়লীর বৃদ্ধ স্বামী যখন মজনুর বুকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে, এতে মজনু মারা যায় সেই সাথে এই অলৌকিক আঘাতে লায়লীও মারা যায়। পরে তাদের দুজনকে একসঙ্গে দাফন করা হয়। এছাড়াও লায়লী মজনুর ভালোবাসার গল্প নিয়ে রয়েছে হাজারো তর্ক বিতর্ক।

তর্ক বিতর্ক যতই থাক। যুগ যুগ ধরে পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন লাইলি মজনুর প্রেম কাহিনী সকলের মাঝে অমর হয়ে থাকবে। 

আমাদের সর্বশেষ আপডেট পেতে  Google News  Follow করুন।

আপনি কি কখনো কাউকে লাইলি মজনুর মত ভালোবেসেছেন তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট করে জানাবেন। ধন্যবাদ। 

"আমি এ দেয়াল পেরোই, সে দেয়াল পেরোই
এ দেয়ালেও চুমু খাই, সে দেয়ালেও
কিন্তু ভেবো না এ ঘর আমার হৃদয় ছিনিয়েছে
ছিনিয়েছে এ ঘরে যে থাকতো সে"

Next Post Previous Post
3 Comments
  • নামহীন
    নামহীন ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ এ ১১:৩৯ PM

    ji amio akjonre vision vabe valo basi ,,relation er boyos 3 bochor hoie gese ,,akhono jani na amader future e ki ache ,, tare pawa hbe kina setaw ojana .. take pawar somvobona onk kom ..but bissas kori tare pabo insaAllah

  • নামহীন
    নামহীন ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ এ ১১:০৩ PM

    Amar jibone ekhono porjonto serokom valobasha aseni , ba amk keu emn kore valo bashe ni but asha kori j vogoban ekdin thik kauke pathaben ❣️

  • সিফু
    সিফু ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ এ ৩:১৮ PM

    মজনুর মতো একজন কে ভালোবাসি। কিন্তু তাকে লাইলীর মতো কখনো পাবো না। তবে জীবনের শেষ অবধি তাকেই ভালোবেসে যাবো।

Add Comment
comment url