শ্রীলংকা দেউলিয়া হলো কিভাবে
শ্রীলংকার বর্তমান অবস্থা
আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকা খুবই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থার এক পর্যায়ে ৩৬ জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছে। এদিকে দেশ ছাড়তে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার বহু মানুষ। পাসপোর্ট অফিসের সামনে মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। এদের মধ্যে বহু শ্রীলঙ্কান নাগরিক চিরদিনের জন্য মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।স্বাধীনতার পর 74 বছরের ইতিহাসে তাদের দেশ সব থেকে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়েছে।
ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কাকে বেসরকারিভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে পাঁচশত টাকায়, চিনি কেজি 400 টাকা আর এক কাপ চা খেতে গুনতে হচ্ছে একশত টাকা। ভোজ্য তেলের অভাবে মাছ-মাংস খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে এখানকার মানুষদের। এর বদলে মানুষ যে নিরামিষ বা শাকসবজি খাবে তা রান্না করার জন্য সিলিন্ডার গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।
অপরদিকে জ্বালানি তেলের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে পাবলিক বাস সার্ভিসগুলো। তেলের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে গত মার্চের 20 তারিখে মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে দুজন বৃদ্ধ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে । এদিকে কাগজের অভাবে শ্রীলংকার স্কুল কলেজগুলোতে বন্ধ হয়ে গেছে পরীক্ষা। এসব খবরা-খবর সেদেশের পত্র পত্রিকাগুলো প্রচার করতে পারছে না। কারণ কাগজের অভাবে তাদের নিজেদের প্রকাশনাযই বন্ধ হয়ে আছে। ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপটিতে জ্বালানি তেলের জন্য হাহাকার এতটা শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে পেট্রোল পাম্পের নিরাপত্তার জন্য সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক মন্দায় হু হু করে নেমে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কান রুপির দাম। আগে যেখানে ৮০ রুপিতে ১ ডলার পাওয়া যেত, এখন সেখানে প্রতি ডলার 295 রুপি। আগে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার মুদ্রার মান সমান থাকলেও বর্তমানে তিন লাখ শ্রীলঙ্কান রুপি পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের 1 লাখ টাকায়। সব মিলিয়ে দেশটির মানুষকে না পেয়ে না খেয়ে লোডশেডিং এর কাফনে অন্ধকারে দিন গুনতে হচ্ছে। যাদের হাতে টাকা আছে তারাও খাবার কিনতে পারছে না। কারণ দোকানে খাবার নেই। সরাসরি টাকা তো আর খাওয়া যায় না ফলে বিক্ষিপ্ত মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। শুরু হয়েছে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ।
প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বাসভবনের বাইরে তুমুল সংঘর্ষের পর দেশটিতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মাত্র কয়েক বছর আগেও মাথাপিছু আয়ে এগিয়ে থাকা দেশটি এত শোচনীয় অবস্থায় কিভাবে পৌঁছে গেল শ্রীলঙ্কা। ঠিক কী কারণে এমন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে মুখ থুবরে পড়েছে দেশটি। এই দুরবস্থা থেকে আদৌ কি পরিত্রান পাওয়া সম্ভব শ্রীলংকার । আর শ্রীলংকার পরে বাংলাদেশের অবস্থা কি হতে যাচ্ছে এ পুরো বিষয় নিয়ে আলোচনা করব আজকে।
শ্রীলংকা কিভাবে দেউলিয়া হল
শ্রীলংকার অর্থনীতির এই সমস্যা রাতারাতি তৈরি হয়নি। এইতো পাঁচ বছর আগেও লঙ্কানদের মাথাপিছু আয় ছিল চার হাজার ডলারের কাছাকাছি । অর্থাৎ শ্রীলংকা পাঁচ বছর আগেও মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ধ্বনি ছিল। গত 15 বছর ধরে এই সমস্যা ধীরে ধীরে পুঞ্জিভূত হয়েছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ক্রমাগত ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকার বিভিন্ন সরকার। সেই তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ শ্রীলঙ্কায় খুব একটা হয়নি।শ্রীলংকা একদিকে ঋণের বোঝায় জর্জরিত অন্যদিকে 2019 সালে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস হলো দেশটির পর্যটন খাত। করোনার কারণে সেটাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
2019 সালের শ্রীলংকা কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক ও কীটনাশক সার ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা হয়। সেজন্য হঠাৎ করেই দেশটির কৃষি উৎপাদন কমে যায় । দেশজুড়ে খাদ্য ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করে । যার ফলে বহির্বিশ্ব থেকে অনেক কৃষি পণ্য আমদানি করতে হয়। অর্গানিক কৃষির কারনে দেশটির অন্যতম রপ্তানি শিল্প চা উৎপাদনও কমে যায় । এর ফলেও শ্রীলংকার অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন করোনার প্রকোপে শ্রীলংকার পর্যটন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ে বড় একটা ক্ষতি হয়েছে ঠিকই কিন্তু এর চাইতে বড় কারন দেশটির সরকারের উচ্চবিলাসী কিছু মেগা প্রকল্পে হাত দেয়া। এর মধ্যে রয়েছে সুবিশাল বিমানবন্দর, গভীর সমুদ্র বন্দর, অপরিকল্পিত কিছু মহাসড়ক ও পানির বাঁধ নির্মান ইত্যাদি প্রকল্প অন্যতম ।
চিননের প্ররোচনায় ও অর্থায়নে এসব প্রকল্পে শ্রীলংকা হাত দিয়েছে চীনেরই দেওয়া মোটা অংকের সুদের ঋণ এর মাধ্যমে। এমনকি সমুদ্রে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে তারা দুবাই সিঙ্গাপুর এবং হংকংকে টেক্কা দিতে চেয়েছিল।
এসব প্রকল্পের জন্য শ্রীলংকা সরকার চীন এডিপি ও জাপানের কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। তারা ভেবেছিল প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর এখান থেকে অর্জিত আয় দিয়ে সেসব ঋণ পরিশোধ করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এসব প্রকল্প কোন কাজেরই নয়। এগুলো ছিল সবই লস প্রজেক্ট।
এছাড়াও প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের ও সীমাহীন দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা শাসক পাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে। এসব কারণে লাভ তো দূরের কথা শ্রীলংকার শীর্ষ প্রকল্পগুলো এখন পর্যন্ত দাঁড়াতেই পারেনি। অথচ ইতিমধ্যেই সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ কোষাগার থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে দেশটিকে। চলতি বছর আরও 690 কোটি ডলার শ্রীলঙ্কাকে পরিশোধ করতে হবে। অথচ তাদের রিজার্ভ আছে মাত্র 230 কোটি ডলার। অর্থাৎ পুরো কোষাগার খালি করেও তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে ন। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা প্রয়োজন। তার জন্য কোন বৈদেশিক মুদ্রা তাদের হাতে নেই।
এখন ভোজ্যতেল জ্বালানি তেল গ্যাস ঔষধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে আবারো বিভিন্ন দেশের কাছে হাত পাততে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে। কিন্তু এবার কোন দেশই তাদের ঋণ দিতে এগিয়ে আসছে না। কারণ এই ঋণের টাকা কবে শ্রীলংকা ফেরত দিতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
শ্রীলংকার এই দুরবস্থা এমন একটি সময় ঘটেছে যখন বাংলাদেশ অনেকগুলো মেগা প্রজেক্টে হাত দিয়েছে। বাংলাদেশের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে চিনা ঋণ। শ্রীলংকার মোট ঋণের পরিমাণ ধরলে চীনের কাছে দেনা তেমন নয়। তাতেই চীনের চাপে ধুঁকছে শ্রীলংকা। আর বাংলাদেশ-চীনের থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে বসে রয়েছে।
আগামী দিনে এই ঋণের অর্থ সুদে আসলে আদায় করবে চীন। বাংলাদেশের অবস্থা যেন শ্রীলঙ্কার মতো না হয় সেজন্য এখন থেকেই সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদগণ । কিন্তু দুর্নীতিতে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম । বাংলাদেশ কি পারবে এ কঠিন ঋণের চাপ কাটিয়ে উঠতে । আপনার কি মনে হয় তা আমাদের কমেন্ট করে জানান ।
ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।