নেমকহারাম দেউড়ি - Nemkaharam Deuri | মীরজাফরের বাড়ি
মুর্শিদাবাদের যতগুলো ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে তারমধ্যে প্রায় 300 বছর আগের পুরানো ভগ্নপ্রায় এই নেমকহারাম দেউড়ি অন্যতম। এই প্রাসাদটি জাফরগঞ্জ প্রাসাদ নামেও বেশ পরিচিত। এখানে সপরিবারে বসবাস করতেন মীরজাফর। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই প্রাসাদেই হত্যা করা হয়েছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। বর্তমানে প্রাসাদটি আর নেই। সময়ের পালাক্রমে এই প্রাসাদটি মাটির সাথে মিশে গেছে । তবে কালের সাক্ষী আজও হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নপ্রায় এই প্রাসাদটির মূল প্রবেশদ্বার। আর এর ভগ্নপ্রায় প্রতিটি ইটের পাঁজরে লুকিয়ে আছে চরম বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস।
নসিপুর রাজবাড়ী যাওয়ার পথে ভাগীরথীর তীরে 300 বছর পুরনো ভগ্নপ্রায় এই প্রাসাদটির অবস্থান। ইতিহাস থেকে জানা যায়। মুর্শিদাবাদের নবাব আলীবর্দী খান এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন তার প্রিয় বোন শাহ খানমের জন্। এই শাহ খানমের সাথে বিয়ে হয়েছিল মীরজাফরের। অবশ্য মীরজাফর যখন বাংলার নবাব হয়েছিলেন তখন তিনি হীরাঝিল প্রাসাদ এ চলে যান।
আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলা হন পরবর্তী নবাব। কিন্তু তা মেনে নিতে পারেনি মীরজাফর ঘষেটি বেগম জগৎশেঠের মত কিছু ব্যক্তি। তারা ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করেছিল সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসন থেকে নামানোর জন্য । আর সেই ষড়যন্ত্র হয়েছিল মীরজাফরের এই বাড়িতেই বযেই। মীরজাফর ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি।
পলাশীর যুদ্ধে তিনি তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি। বরং সিরাজউদ্দৌলা কে পরাজিত করার জন্য সমস্ত প্রকার ফন্দি এঁটে ছিলেন। যুদ্ধের পরিস্থিতি ভালো না দেখে সিরাজউদ্দৌলা স্ত্রী লুৎফুন্নেছা বেগম এবং মেয়ে জোহরা কে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদ থেকে প্রথমে ভগবানগোলা গিয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। দিন দুয়েক পর কয়েকবার বেশভূষা বদল করে
সিরাজউদ্দৌলা পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজমহলের কাছে।
তিনদিন ধরে কিছু খাওয়া হয়নি তাদের তাই একটু বিরতি নিয়েছিলেন সবাই। সেদিন খাওয়ার জন্য রান্না করা হয়েছিল খিচুড়ি। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। ওই এলাকায় থাকতেন শাহানা নামের একজন ফকির। মাত্র কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রার লোভে সে গোপনে খবর পৌঁছে দেয় মীরজাফরদের কাছে যে সিরাজউদ্দৌলা এখানে আছে। এ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল মীরজাফর মিরনেরা। দিনরাত এক করে যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল গোটা বাংলায় সেই সিরাজ এত কাছে রয়েছেন।
খবর পেয়েই মীরজাফরের জামাই মীর কাসিম সশস্ত্র সৈন্যদের নিয়ে নদী পার হয়ে এসে ঘিরে ফেললেন গোটা এলাকা। বন্দী সিরাজউদ্দৌলাকে ২রা জুলাই 1757 সালে নিয়ে আসা হল মুর্শিদাবাদে। রবার্ট ক্লাইভ তখন সেখানেই ছিলেন। জাফরগঞ্জ এর এই প্রাসাদে পদচ্যুত নবাব কে মাঝরাতে হাজির কাল মীরজাফরের সামনে । তখন মীরজাফরের সামনে কাঁপতে কাঁপতে প্রাণভিক্ষা করেছিলেন সিরাজউদ্দৌলা।
এইসময় সিপাহীরা মহলের অন্যদিকে নিয়ে যায় সিরাজউদ্দৌলাকে। ওদিকে মীরজাফর তার পরিষদদের সাথে আলোচনায় বসলেন। সিরাজউদ্দৌলার সাথে কি করা উচিত সেই বিষয় নিয়ে। তাদের সামনে তিনটি পথ খোলা ছিল। হয় তাকে মুর্শিদাবাদেই বন্দি করে রাখা হোক। অথবা দেশের বাইরে অন্য কোথাও বন্দী করে রাখা হোক। তৃতীয় বিকল্প ছিল তাকে মেরে ফেলা। অনেকেই চেয়েছিলেন' সিরাজউদ্দৌলাকে বন্দি করে রাখতে। কিন্তু মীরজাফরের 17 বছরের ছেলে মিরন তাতে রাজি হননি । তবে মীরজাফর তখন কোন মতামত না দিয়ে চুপ করে থাকেন ।
মীরজাফর যেহেতু নিজস্ব কোন মতামত দেয়নি সিরাজউদ্দৌলা কে নিয়ে তাই সেটাকে মিরন বাবার সম্মতি বলে ধরে নিয়েছিল। মীরজাফর অনেক রাতে দরবার শেষ করে ঘুমাতে চলে যান। এইসময় সিপাহীরা সিরাজউদ্দৌলাকে মহলের অন্য দিকে নিয়ে যায় । মিরন মোহাম্মদী বেগ কে দায়িত্ব দিলেন সিরাজউদ্দৌলা কে হত্যা করার। মোহাম্মদী বেগ এর আরেকটি নাম ছিল লাল মোহাম্মদ। তিনি সিরাজউদ্দৌলার খুব কাছের ও প্রিয় একজন মানুষ ছিল । মিরন সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে সিরাজউদ্দৌলার কাছে গেল তাকে মারার জন্য । আর সিরাজউদ্দৌলা তখনই বুঝতে পেরেছিল কি হতে চলেছে তার সাথে ।
সিরাজউদ্দৌলা তাদেরকে বললেন তাকে মেরে ফেলার আগে তাকে যেন ওযু গোসল করে নামাজ পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু নিজেদের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার তাগিদে মোহাম্মদী বেগ সিরাজের মাথায় এক ঘটি পানি ঢেলে দেয়। তিনি যখন বুঝলেন তাকে ঠিকমত গোসল করতে দেওয়া হবে না। তখন তিনি খাওয়ার জন্য একটু পানি দিতে বললেন। ঠিক তখনই মোহাম্মদী বেগ ছুরি দিয়ে সিরাজউদ্দৌলার উপর প্রথম আঘাত হানলেন। মোহাম্মদী বেগ এর আঘাত করার পরপরই বাকিরা তলোয়ার দিয়ে এলোপাথারি ভাবে আঘাত করতে থাকলো সিরাজউদ্দৌলার উপর । কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের কাজ শেষ হলো।
সিরাজউদ্দৌলার মাথাটা ঝুঁকে পড়লো ,নিথর দেহটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে । তখন সিরাজউদ্দৌলার বয়স ছিল মাত্র 25 বছর। সেদিন সারারাত সিরাজউদ্দৌলার মৃতদেহ এই প্রাসাদের মেঝেতেই পড়ে ছিল।
এরপর নিয়তির পরিহাসে কিছুদিন পর মীরজাফরকেও ছাড়তে হয়েছিল এই প্রাসাদ। নবাব হয়েও বেশিদিন টিকতে পারেননি তিনি। ইংরেজরা শুধু তাকে নামেমাত্র নবাব বানিয়ে রেখেছিলেন । তার সাথে গাধার মত ব্যবহার করত ইংরেজরা।
যুগ যুগ ধরে এই এলাকায় প্রাসাদটি নেমকহারামের প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে। আর মীরজাফর নামটি একটি গালি তে পরিণত হয়েছে।
শোনা যায় ১৮৯৭ সালে একটি ভূমিকম্পে এই প্রাসাদটি ভেঙে যায়। যেন প্রকৃতিও চায়না এই বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন বাংলার মাটিতে থাকুক।