বাত রোগের চিকিৎসা ও প্রতিকার

বাত–ব্যথা বা পেইন একটি পুরাতন রোগ। মানব জাতির জন্মলগ্ন থেকেই শরীরে ব্যথার অস্তিত্বের অনুভব হয়েছে। তবে ইতিহাস বলে, প্রাচীন যুগে এই রোগের একজন গ্রিক দেবী ছিলেন। যাঁর নাম ছিল ‘পোইন’, তাঁর এই নাম থেকেই ব্যথার সৃষ্টি। তবে এটি একটি গ্রিক পুরাণের ধারণা। এখন বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় ব্যথা সম্পর্কে বিশদভাবে জানা যায়।

প্রথমত, ব্যথা কোনো রোগ নয়, উপসর্গ মাত্র। শরীরে নানা কারণে ব্যথা অনুভব হতে পারে। তবে এই প্রতিবেদনে বাত–ব্যথার নানা রোগ নিয়ে কিছু পরামর্শ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা থাকবে। সাধারণত মানুষ তাঁর শরীরের বিভিন্ন হাড়, জয়েন্ট অথবা শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমন-ঘাড়, কোমর, হাঁটু, কনুই, কবজি, রগ বা টেনডন বা মাংশপেশী ইত্যাদিতে বাত–ব্যথায় ভোগেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে আমাদের দেশে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ বাত–ব্যথা রোগে ভুক্তভোগী।

প্রকৃতপক্ষে কোমরব্যথা রোগকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। সবদিক বিবেচনা করলে এটি একটা জটিল সমস্যা। ব্যথা যে কারণেই হোক না কেন, দ্রুত সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই ব্যথা সেরে ফেলতে হবে। তাছাড়া তিন মাসের বেশি যেসব ব্যথা থাকবে সেই সব কোমরব্যথার চিকিৎসা সাধারণত পরবর্তী সময়ে অনেক কষ্টকর হয়ে থাকে আর তা সহজে ভালো হয় না।

ঘাড়ব্যথা

নারী–পুরুষ উভয়েরই যেকোনো বয়সে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বয়সভেদে ব্যথার কারণ আলাদা হতে পারে। ঘাড়ে ব্যথার প্রধান কারণগুলো হলো—

সারভাইক্যাল স্ট্রেইন বা স্পাজম

সারভাইক্যাল স্পনডাইলেসিস

সারভাইক্যাল ডিক্স প্রলাপস

সারভাইক্যাল ইনজুরি

ফাইব্রোমায়লজিয়া

বাত–ব্যথা রোগের চিকিৎসা ও প্রতিকার

এ ছাড়া বিভিন্ন প্রদাহজনিত বাতজ্বর বা রিউমাটিক রোগেও ঘাড়ব্যথা হয়। যেকোনো বয়সেই ঘাড়ে ব্যথা হলে প্রথমে এর সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করতে হবে। সেই অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা নিলে অবশ্যই রোগ নিরাময় হবে। এ রোগের জন্য অবশ্যই একজন ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যাতে করে আপনার সঠিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পারেন।

কোমরব্যথা বা ব্যাক পেইন

কোমরব্যথা মানবদেহের একটি বিড়ম্বনা সৃষ্টিকারী রোগ বা উপসর্গ। পৃথিবীর অনেক নারী–পুরুষই এ রোগের ভুক্তভোগী। সাধারণত ৩০ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মানুষ এই ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের জীবনের কোনো না কোনো সময় কোমরব্যথা হয়েছে বা হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। এতে যেমন কর্মক্ষমতা লোপ পায়, তেমনি নষ্ট হয় কর্মের সময়ও। পাশাপাশি রয়েছে মানসিক বিপর্যয় ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দিক। আর চিকিৎসা বাবদ যে অর্থ ব্যয় হয়, তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।

যুক্তরাজ্যের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা ৭ ভাগ মানুষ (২৫ থেকে ৫৫ বছর) প্রতিবছর কোমরব্যথার কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এতে চিকিৎসাবাবদ ব্যয় হয় বছরে প্রায় ৫০ কোটি পাউন্ড ও নষ্ট হয় আট কোটি কর্মদিবস। বাংলাদেশেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লোক কোমরব্যথা বা অন্যান্য ব্যথায় ভোগেন।

কমরব্যথার কারণ

এখন আমরা জেনে নিই, কোমরব্যথার কারণগুলো এবং কারা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। সাধারণত ৪০ বছরের আগে ও চল্লিশোর্ধ বয়সের মানুষের কোমরব্যথার কারণগুলো আলাদা হতে পারে। অর্থাৎ বয়স ও লিঙ্গভেদে কোমরব্যথার কারণ আলাদা হয়ে থাকে। যাঁরা শারীরিকভাবে বেশি পরিশ্রম করেন যেমন—ওজন বহন করা, ওজন তোলা, অনেকক্ষণ দাঁড়ানো, অনেকক্ষণ বসা, সামনে ঝুঁকে কাজ করা, বসে কাজ করা এই সব কারণেই সাধারণত কোমরব্যথা হয়ে থাকে। আবার পড়ে গেলে বা আঘাত লাগলেও অনেক সময় কোমরব্যথা হয়। হাড়ের ক্ষয় থেকেও এ ব্যথার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ব্যথাকে বলে ‘ডিজেনারেটিভ ডিস অর্ডার’। এছাড়া ক্যানসার, পিত্তথলি ও অগ্ন্যাশয়ের অসুখ , যক্ষ্মা, এমনকি ইনফেকশন থেকেও কোমরব্যথা হতে পারে।

হাঁটুব্যথা

পড়ন্ত বয়সে কিংবা একটু বেশি বয়স হলে বিভিন্ন কারণে হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। সচরাচর ৩০-৬০ বছর বয়সে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ হাঁটুর ব্যথায় ভোগেন। সুতরাং হাঁটুব্যথা একটি অতি সাধারণ আর্থ্রাইটিস, যা একটু বেশি বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করে। সাধারণত, পুরুষের চেয়ে নারীদের হাঁটুব্যথা বেশি হয়। এ ক্ষেত্রে নারীদের দুই হাঁটুই এক সঙ্গে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুর তরুণাস্থির গঠনগত কিছু পরিবর্তন হয় বা কিছুটা ক্ষয় হতে থাকে। এইভাবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অস্থি, তরুণাস্থি ও অস্থি সংযোগে কিছুটা ক্ষয় হতে থাকে। অল্প ক্ষয়ের কারণে অনেক সময় কোনো উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে। ফলে রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু ক্ষয়ের মাত্রা বেশি হলে তখন রোগীদের দেহে বিভিন্ন রকম উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন—হাঁটুতে ব্যথা হওয়া, মুভমেন্ট কমে যাওয়া, ফুলে যাওয়া এবং অনেকেসময় হাঁটুতে পানি জমে যেতে পারে ইত্যাদি।

বয়সভেদে হাঁটুব্যথার অনেক অন্তর্নিহিত কারণ থাকতে পারে। কম বয়স বা তরুণদের যে কারণে ব্যথা হয়, বেশি বয়সের কারণগুলো আলাদা হতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে কারণে হাঁটুব্যথা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

জিনগত

সথূলতা বা ওবেসিটি

আঘাতজনিত

রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস

গেটে বাত

ইনফেকশন বা সংক্রমণজনিত

টিবি বা যক্ষ্মা

পেটের পীড়া যেমন—আলসারেটিভ কোলাইটিস

যৌন সংক্রমণ জাতীয় রোগ যেমন—গনোরিয়া, ক্লামাইডিয়া, সিফিলিস, ইনফেকসন ইত্যাদি।

এই সংক্রমণগুলো সাধারনত হাঁটুব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

কোমর ব্যথার প্রতিকার

পিঠে ব্যথা হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, তবে তেমন নয়। সামান্য ব্যথার জন্য সামান্য ব্যথার ওষুধ এবং নিয়ম মেনে অনেক সময় ব্যথা ভালো হয়ে যায়। যেমন, শক্ত বিছানায় শুয়ে, কোমরে গরম স্নান করা, দু-একদিন বিশ্রাম নেওয়া এবং সাধারণ ব্যথানাশক ওষুধ অল্প পরিমাণে খাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই উপকারী। পিঠে ব্যথা বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এক্ষেত্রে একজন ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ খুবই প্রয়োজন।

হাঁটু ব্যথায় করণীয়

বয়স নির্বিশেষে প্রথমে হাঁটু ব্যথার সঠিক কারণ নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসন্দেহে, কিছু ক্ষেত্রে, রোগটি নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণ করা হবে যদি রোগটি নিশ্চিত করা যায় এবং উপযুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিত্সা করা হয়। শারীরিক থেরাপির পাশাপাশি হাঁটু ব্যথার ওষুধ ব্যবহারের অনেক সুবিধা রয়েছে। এই ক্ষেত্রে, একজন চিকিত্সক যিনি ফিজিক্যাল মেডিসিনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

লেখক: অধ্যাপক, ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা এবং বাত, ব্যথা, পক্ষাঘাত ও জয়েন্ট রোগ বিশেষজ্ঞ


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url