ফখরুদ্দিনের শাসন আমল কেমন ছিল | ১/১১ সরকার

2007 সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। তখন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করছিল । এক পর্যায়ে ডঃ ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান । আর নতুন করে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডঃ ফখরুদ্দীন আহমেদ। সেই সময়ে দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে 11 ই জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির দিনটিকে ১/১১ বা one eleven  নামে আখ্যায়িত করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ।

রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কে একরকম নিরব বিদ্রোহে সরানোর  পেছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন সেসময়ের সেনাপ্রধান এই মইন ইউ আহমেদ। মইন ইউ শুধু ইয়াজউদ্দিন সরকারকেই হঠান নি পরবর্তী দুই বছর তার ইশারাতেই চলেছে পুরো বাংলাদেশ। 


জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় দলগুলোর মধ্যে বিশৃঙ্খলার পরিপ্রেক্ষিতে 12 ই জানুয়ারি 2007 সালে  তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। একই সাথে সেনা-সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ফকরুদ্দিন আহমেদ কে নিয়োগ করা হয়। 


কেমন ছিল ফখরুদ্দিন সরকার


হঠাৎ করেই দেশের ক্ষমতার মসনদে বসে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন  ডঃ ফখরুদ্দীন আহমেদ । সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থাকাকালে তিনি দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ চালিয়েছেন দুই বছর। ফকরুদ্দিন আহমেদ ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইতিপূর্বেই রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হয়। তিনি 2 বছর সরকারের কেয়ারটেকার ছিলেন। 

ফখরুদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণের পর তৎকালীন জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য তিনি সর্বমহলেই বেশ প্রশংসিত হন। সে সময় বিশ্বের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশকে  ফকরুদ্দিন আহমেদ দুর্নীতিমুক্ত করতে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সে সময় দেশের 160 জন রাজনীতিবিদ সরকারি কর্মকর্তা নিরাপত্তা কর্মকর্তার নামে অর্থ আত্মসাৎ ও অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগ এনে  মামলা করা হয়। 


2007 সালের 11 ই জানুয়ারি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে সংগঠিত রাজনৈতিক পরিবর্তন 1/11 নামে প্রচার লাভ করে। সেনাবাহিনীর সমর্থনে ঐসময় গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে  ফকরুদ্দিন আহমেদ থাকলেও । ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ। মূলত সবকিছুই তার ইশারায় পরিচালিত হতো।


2007 সালে জানুয়ারিতে আয়োজিত নির্বাচন বানচালের জন্য মইন ইউ আহমেদের প্রশংসা করা হবে নাকি নিন্দা জানানো হবে সে নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। যদিও জেনারেল মইন তার দেয়া দুটি প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। এগুলো হচ্ছে স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করেছেন এবং ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। জেনারেল মইন ইউ আহমেদ কে এক-এগারোর প্রধান নায়ক হিসেবে মনে করা হয়। তার বই শান্তির স্বপ্নে তিনি নিজেও এমনটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। রাজনীতিতে কোনোভাবেই তিনি সেনাবাহিনীকে জড়াতে চান নি এ কথা বারবার শান্তির স্বপ্নে বইতে লিখেছেন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। 


এক-এগারো পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পিছনে সেনাবাহিনী সরাসরি না থাকলেও সবখানেই যে তাদের প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপ ছিল একথা সবাই জানে। যে কারণে দেশে বিদেশে ওই সরকার  সেনাসমর্থিত সরকার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। জেনারেল মইন ইউ আহমেদ বলেছেন জাতিসংঘের একটি প্রচ্ছন্ন হুমকির কথা যেখানে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তিনি লিখেছেন সেনাবাহিনীর সীমিত আয়ের চাকরিতে সৈনিকদের একমাত্র অবলম্বন  জাতিসংঘ মিশন। তাদের সামনে থেকে যদি সেই সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। তখনকার সময়ের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে জেনারেল মইন ইউ আহমেদ বইতে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি বলে বর্ণনা করেছেন। 


বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর মূল কর্তাদের কাজ হয় প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি এমন একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি খুঁজে বের করা। জেনারেল মইন ইউ আহমেদ লিখেছেন বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন তাদের দুটো নাম প্রস্তাব করেছিল। একজন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস অপরজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফকরুদ্দিন আহমেদ। 


প্রফেস ইউনুস কে প্রথম ফোনটি করেন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। প্রফেস ইউনুস অস্বীকৃতি জানান। এরপর ডঃ ফখরুদ্দীন আহমেদ কে গভীর রাতে ফোন করে ঘুম থেকে জাগানো হয়। প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় চান তিনি। আধাঘন্টা পর ফিরতি ফোনে তিনি সম্মতি জানান। 


ওই দিন টিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাবহুল দিন নাইন ইলেভেন এর মত করে 1/11 হিসেবে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত তারাই নিয়েছিলেন বলে বইতে লিখেছেন মইন ইউ আহমেদ। 


দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান ও সহিংসতার কারণে সহিংসতা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম ব্যর্থতা এবং এর ফলে পশ্চিমাদের সমর্থনের ফল হিসেবে ঐদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে যায় সেনাসমর্থিত অরাজনৈতিক সরকারের হাতে। 


কথা ছিল ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্রুততম সময়ে দেশবাসীকে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন উপহার দেবেন। কিন্তু ঘটলো তার উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া কে দেশের রাজনীতি থেকে বিদায়ের চেষ্টা করার অভিযোগ ওঠে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ ও জরুরি অবস্থা জারির ছয় মাসের মধ্যে 2007 সালের 16 ই জুলাই ভোর রাতে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয় তেশরা সেপ্টেম্বর। 


এরপর প্রচন্ড আন্দোলন আর সংগ্রামের তোপের মুখে এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া মুক্তি দেয়া হয়। তখন গ্রহণযোগ্য একটি সাধারণ নির্বাচনের জন্য সেনাসমর্থিত সরকারের উপর চাপ নতুন করে আরো বেড়ে যায়।


অবশেষে 2008 সালের 29 ডিসেম্বর সব দলের সতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং এতে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে ফখরুদ্দিন আহমেদ গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্ত হয়। 


এরপর 2009 সালের র জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ফকরুদ্দিন আহমেদ। 2009 সালের 14 ই জুন অবসরে যান তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। একই বছর 14 ই জুলাই ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে এ সংক্রান্ত একটি টেলিগ্রাম বার্তা ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়। উইকিলিকস টেলিগ্রামটি ফাঁস করেছিল। 


সেই টেলিগ্রামটিতে বলা হয় 14 ই জুন সেনাপ্রধানের অবসর নেওয় মইন ইউ আহমেদ হিরো ছিলেন নাকি ভিলেন ছিলেন এই নিয়ে বাংলাদেশিরা তর্কে বিতর্কে নেমেছে । অনেকেই বলছেন 2007 সালের নির্বাচন দুই বছর পিছিয়ে দিয়ে মইন ইউ বাংলাদেশের সংবিধান লংঘন করেছেন। আবার কেউ কেউ  বলছেন রাজনৈতিক অস্থিরতা বন্ধ করার জন্য  মইন ইউ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এজন্য তাকে পুরস্কৃত করা উচিত। 


সেই টেলিগ্রাম বার্তায় আরো বলা হয় বিতর্কিত লোক হলেও মইন ইউ তার কথা রেখেছেন। 2008 সালের নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বাধীন ও স্বচ্ছ নির্বাচন। 2007 সালে ক্ষমতায় থাকার সময় ব্যাপক গুঞ্জন ছিল যে মইন ইউ আহমে রাজনীতিতে নামতে যাচ্ছেন। তবে বিভিন্ন বক্তব্যে  মইন ইউ আহমেদ এসব গুঞ্জন নাকচ করে দিয়েছেন। তবে 2008 সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেনাপ্রধান হিসেবে মইন ইউ আহমেদের আরো এক বছর মেয়াদ বাড়ায় তখন সাধারণ মানুষ ধরে নেয় যে মইন ইউ আহমেদ রাজনীতিতে নামবেন বলেই এমনটা করা হচ্ছে। তবে এ সব কিছুরই অবসান হয় যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।


মইন ইউ আহমেদ 2008 সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার শাসনামলেও সেনাপ্রধান ছিলেন। পরে অবসর নিয়ে অনেকটা নিরবে 2009 সালের জুন মাসে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান মইন ইউ আহমেদ। তবে দেশের রাজনীতিতে এখনো ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন ইয়াজউদ্দিন নামগুলো একসঙ্গে আলোচিত হয়। 


1/11 এর পূর্ববর্তী সময়ের রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডঃ ইয়াজউদ্দিন আহমেদ 2012 সালের 10 ডিসেম্বর 81 বছর বয়সে থাইল্যান্ড এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরন করেন। 


আর ফখরুদ্দিন আহমেদ এবং মইন ইউ আহমে এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সে সময় মঈন ইউ আহমেদ কে সহযোগিতা করা একাধিক সাবেক সেনা  ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার ঠিকানাও হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। 


বন্ধুরা ১ /১১ বা ফখরুদ্দিনের শাসনামল ভালো ছিল নাকি বর্তমান সময়ের শাসনব্যবস্থা ভালো আপনার কি মনে হয় তা আমাদের কমেন্টস করে জানান । ধন্যবাদ সবাইকে আল্লাহ হাফেজ।


Next Post Previous Post
1 Comments
  • নামহীন
    নামহীন ১৮ আগস্ট, ২০২৩ এ ১০:৪২ PM

    অনেক ভালো ছিলো (উদ্দিন)৩

Add Comment
comment url