পদ্মা সেতুর টোল এত বেশি কেন
পদ্মা সেতুর টোল বেশি কেন
স্বপ্নের সেতু পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক নতুন সম্ভাবনার মাত্রা যোগ করেছে কিন্তু এই সেতু পার হতে যানবাহনের যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে তা ফেরির ভাড়ার দেড় গুণ এবং যমুনা সেতুর টোল এর প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পদ্মা সেতুতে পৌঁছানোর জন্য যে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সেই সড়কের জন্যও যানবাহনকে আলাদা করে টোল দিতে হবে।
সব মিলিয়ে বলতে গেলে জনগণের স্বার্থে এই মহা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা জনগণের কতটুকু স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে তাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় পদ্মা সেতুর এই ধার্যকৃত টোল কতটা যুক্তিসঙ্গত, জনগনের টাকায় ব্রিজ করে আবার জনগন থেকেই কেন এত বেশি টোল নেয়া হচ্ছে তার বিস্তারিত আলোচনা থাকছে আজকের এপিসোড।
পদ্মা সেতুর টোল এত বেশি কেন
বর্তমানে ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে যানবাহনের ভাড়া দিতে হয় 70 থেকে 3940 টাকা কিন্তু পদ্মা সেতুতে যানবাহন ভেদে 100 থেকে 6000 টাকা পর্যন্ত টোল দিতে হচ্ছে। পদ্মা সেতু ও ফেরীর টোলের পার্থক্য হল বড় বাস ২৪০০ টাকা ফেরিতে ১৫৮০ টাকা মাঝারি বাস ২০০০ টাকা ফেরিতে ১৩৫০ টাকা ছোট বাস ১৪০০ টাকা ফেরিতে ৯৫০ টাকা বড় ট্রাক ৫৫০০ টাকা ফেরিতে ৩৯৪০ টাকা মাঝারি ট্রাক ওজনভেদে ২১০০ টাকা থেকে ২৮০০ টাকা যা ফেরিতে ১৪০০ থেকে ১৮৫০ টাকা। এছাড়া মোটরসাইকেল কার জিপ পিকআপ এবং মাইক্রোবাসের ভাড়া যথাক্রমে 30 250.400 এবং 440 টাকা ফেরির ভাড়ার চেয়ে বেশি।
এই টোল 15 বছরের জন্য প্রযোজ্য হবে । প্রতি 15 বছর পরপর টোলের হার 10% হারে বাড়বে । কোরিয়া এক্সপ্রেস কর্পোরেশন এবং চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি আগামী পাঁচ বছরের জন্য টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তের যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতুর নদী শাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে এর জন্য পাঁচ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা ।
পদ্মা সেতু ব্যবহার করতে হলে ঢাকার পোস্তগোলা বা বাবুবাজার থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সেখানেও আলাদা করে টোল দিতে হবে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের দূরত্ব 55 কিলোমিটার । এই পথে বাসে 495 এবং ট্রাকের 550 টাকা টোল দিতে হবে তবে। এই টোল আরো বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
তার মানে কেউ যদি পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের কোন জেলায় যাতায়াত করতে চায় তাহলে তার যে খরচ হবে তার নদীপথের চেয়ে অনেক বেশি ।। এর পক্ষে অবশ্য একটি যুক্তি রয়েছে আর তা হলো এক্সপ্রেসওয়ে এবং সেতু ব্যবহার করলে অনেক সময় বাঁচবে কিন্তু এই সময় বাঁচাতে গিয়ে বাসের ভাড়া যে কতগুণ বৃদ্ধি পাবে তা সহজেই কল্পনা করা যায়।
দক্ষিণের জেলাগুলো থেকে থেকে ঢাকায় আসা পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাবে অথচ পদ্মা সেতু হলে পণ্য আদান-প্রদান সহজ ও সুলভ হওয়ার কথা । তার মানে একদিকে যাতায়াত সহজ হবে অন্যদিকে খরচ বেড়ে যাবে । সেই বাড়তি খরচ সাধারণ মানুষকেই শোধ করতে হবে । পদ্মা সেতু দেশের সাধারণ জনগণের টাকায় তৈরি হয়েছে এই সেতু নির্মাণে কোন বিদেশী ঋণ নেই অথচ উচ্চহারে টোল দিয়ে তার ভোগান্তিও নিতে হবে সাধারণ মানুষকে।ম্মম্
পদ্মা সেতুর টোল এত বেশি কেন
এবার চলুন আমরা একটু জেনে আসি পদ্মা সেতুর টোল কি কি মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে নির্ধারন করা হল । তাহলে কিছুটা ধারনা পাওয়া যাবে আসলে পদ্মা সেতুর ধার্যকৃত টোল আসলেই বেশি না কম ।
প্রথমত ফেরতের হার বা rate of return - অর্থাৎ প্রকল্পে যত টাকা খরচ করা হয়েছে তার বিপরীতে জনগণ কত টাকার সুবিধা পাবে । একটি আদর্শ বিনিয়োগে ফেরতের হাড় হল কমপক্ষে ১২% । বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা গেছে পদ্মা সেতুর ফেরতের হাড় ১৯% । অর্থাৎ কেউ পদ্মা সেতুতে 100 টাকা খরচ করলে 119 টাকার সুবিধা পাবে ।
দ্বিতীয়তঃ শ্রমঘন্টা । পদ্মা সেতুতে যান চলাচলের মাধ্যমে ফেরীর তুলনায় অনেক সময় বেচে যাবে আর সেই বেচে যাওয়া সময়টা অন্য কোন কাজে লাগানো যাবে।
তৃতীয়তঃ দৈনিক যানবাহন চলাচলের সংখ্যা । জাইকার মতে পদ্মা সেতু চালু হলে আগের তুলনায় ৯ গুন বেশি গাড়ি চলাচল করবে । ফলে একটি গাড়ি আগের তুলনায় বেশি চলাচল করতে পারবে অর্যাৎ আগের থেকে কমপক্ষে আট বার বেশি চলাচল করতে পারবে।
চতুর্থত ঋণের পরিমাণ সুদের হার ঋণ পরিমাপের ব্যাপ্তি । বাংলাদেশের অর্থবিভাগ সেতু বিভাগ কে ৩০১৯৩.৩৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে । যা 1% সুদের হারে অর্থত্বিভাগকে পরিশোধ করতে হবে সেতু বিভাগ কে । এই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রেখেই ব্রিজের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে।
2007 সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল 10 হাজার 161 কোটি টাকা 2011 সালে এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় 20 হাজার 507 কোটি টাকা ২০১৬ সালে হয় 28 হাজার 793 কোটি এবং 2018 সালে সেতু নির্মাণের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় 30 হাজার 193 কোটি টাকা সম্পূর্ণ কাজ এখনো শেষ হয়নি তাই খরচ আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নকশা পরিবর্তন হয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ার কারণে নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে এছাড়া সময়ের সাথে সাথে প্রকল্প এলাকায় জমির মূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে এসব কারণে খরচ বেড়ে যাওয়া হয়তো অযৌক্তিক নয় কিন্তু বাংলাদেশের সকল ধরনের সরকারি অবকাঠামো নির্মাণে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও অনেক বেশি খরচ হয় তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তাছাড়া দেশের সরকারি সকল প্রকল্পে দুর্নীতির ছোয়া তো রয়েছেই।
ঢাকা থেকে সড়কপথে খুলনার দূরত্ব প্রায় 250 কিলোমিটার কিন্তু পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করলে দূরত্ব কমে দাঁড়াবে 190 কিলোমিটার 65 কিলোমিটার পথ কমে আসবে এতে জ্বালানি খরচ কমবে সাধারণত এক লিটার ডিজেলের দাম ৮৫ টাকা। 65 কিলোমিটার পথ কমে যাওয়ায় ঢাকা-খুলনা বাসে জ্বালানি খরচ কমবে প্রায় 1785 টাকা আর ট্রাকে জ্বালানির খরচ কমবে 1170 টাকা থ্রি উয়লারে 2763 টাকা মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়িতে 579 টাকা এবং মোটরসাইকেলের জ্বালানি খরচ কমবে 134 টাকা ।
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোরের দূরত্ব বর্তমানে 212 কিলোমিটার থেকে প্রায় 50 কিলোমিটার কমে যাবে এতে বাসে জার্নি বাঁচবে প্রায় 17 লিটার
অর্থাৎ খরচ বাড়লেও যানবাহনগুলোর জ্বালানি খরচ কমে যাচ্ছে সে কথা বিবেচনায় রেখে কতটা ভারসাম্যপূর্ণ ভাড়া নির্ধারণ হয় সেটাও কিন্তু দেখার বিষয় ভারসাম্যপূর্ণ ভাড়া যদি নির্ধারিত না হয় তাহলে জনগণকে দূর্ভোগে পড়তে হবে।
প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের মানুষ পদ্মা সেতুর জন্য অপেক্ষা করছে অ্যামাজনের পর পদ্মা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গতি সম্পন্ন নদী পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং শুরুতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করতে আগ্রহী দেখিয়েছিল 2011 সালে এই প্রকল্পের জন্য বিশ্ব ব্যাংক 120 কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীতে 2012 সালের জুলাই মাসে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ঋণচুক্তি বাতিল করে । অবশেষে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ বানিয়ে ফেলল পদ্মা সেতু ।